হযরত ইবরাহীম (আ:)

 

হযরত ইবরাহীম (আ:) এর পরিচয় :

ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ছিলেন হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্ভবত: এগারোতম অধঃস্তন পুরুষ। নূহ থেকে ইবরাহীম পর্যন্ত প্রায় ২০০০ বছরের ব্যবধান ছিল। হযরত ছালেহ (আঃ)-এর প্রায় ২০০ বছর পরে ইবরাহীমের আগমন ঘটে। ঈসা থেকে ব্যবধান ছিল ১৭০০ বছর অথবা প্রায় ২০০০ বছরের। তিনি ছিলেন ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের পিতা এবং তাঁর স্ত্রী ‘সারা’ ছিলেন ‘উম্মুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের মাতা। তাঁর স্ত্রী সারার পুত্র হযরত ইসহাক্ব-এর পুত্র ইয়াকূব (আঃ)-এর বংশধর ‘বনু ইসরাঈল’ নামে পরিচিত এবং অপর স্ত্রী হাজেরার পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে জন্ম নেন বিশ্বনবী ও শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ
(ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। যাঁর অনুসারীগণ ‘উম্মতে মুহাম্মাদী’ বা ‘মুসলিম উম্মাহ’ বলে পরিচিত।
বাবেল হ’তে তিনি কেন‘আনে (ফিলিস্তীন) হিজরত করেন। সেখান থেকে বিবি সারা-র বংশজাত নবীগণের মাধ্যমে আশপাশে সর্বত্র তাওহীদের দাওয়াত বিস্তার লাভ করে। অপর স্ত্রী হাজেরার পুত্র ইসমাঈলের মাধ্যমে বায়তুল্লাহ ও তার আশপাশ এলাকায় তাওহীদের প্রচার ও প্রসার হয় এবং অবশেষে এখানেই সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটে। এভাবে ইবরাহীমের দুই স্ত্রীর বংশজাত নবীগণ বিশ্বকে তাওহীদের আলোয় আলোকিত করেন। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দেহসৌষ্ঠব ও চেহারা মুবারক পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর ন্যায় ছিল। যা তিনি মে‘রাজ থেকে ফিরে এসে উম্মতকে খবর দেন।[1]

আবুল আম্বিয়া ও সাইয়েদুল আম্বিয়া :

ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন ইহুদী-খৃষ্টান-মুসলমান সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পিতা। কেননা আদম (আঃ) হ’তে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত ১০/১২ জন নবী বাদে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত ১ লাখ ২৪ হাযার পয়গম্বরের প্রায় সকলেই ছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
ﺇﻥَّ ﺍﻟﻠّﻪَ ﺍﺻْﻄَﻔَﻰ ﺁﺩَﻡَ ﻭَﻧُﻮْﺣﺎً ﻭَﺁﻝَ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ ﻭَﺁﻝَ ﻋِﻤْﺮَﺍﻥَ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻌَﺎﻟَﻤِﻴْﻦَ

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ, আলে ইবরাহীম ও আলে ইমরানকে বিশ্ববাসীর উপরে নির্বাচিত করেছেন’ (আলে ইমরান ৩/৩৩)। এই নির্বাচন ছিল বিশ্ব সমাজে আল্লাহর তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য। ইবরাহীম ছিলেন নবীগণের পিতা এবং পুত্র মুহাম্মাদ ছিলেন নবীগণের নেতা, এ বিষয়টি সর্বদা মুমিনের মানসপটে জাগরুক রাখার জন্য দৈনিক ছালাতের শেষ বৈঠকে পঠিত দরূদের মধ্যে ইবরাহীম ও মুহাম্মাদের উপরে এবং উভয়ের পরিবার বর্গের উপরে আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষণের জন্য দো‘আ করার বিধান রাখা হয়েছে। ইবরাহীমের বংশে বরকত হ’ল নবুঅত ও ঐশী কিতাবের বরকত এবং মুহাম্মাদের ও তাঁর বংশে বরকত হ’ল বিজ্ঞানময় কুরআন ও হাদীছ এবং তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার বরকত।
ইবরাহীম ও তাঁর বংশধর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

ﻭَﻭَﻫَﺒْﻨَﺎ ﻟَﻪُ ﺇِﺳْﺤَﺎﻕَ ﻭَﻳَﻌْﻘُﻮْﺏَ ﻭَﺟَﻌَﻠْﻨَﺎ ﻓِﻲْ ﺫُﺭِّﻳَّﺘِﻪِ ﺍﻟﻨُّﺒُﻮَّﺓَ ﻭَﺍﻟْﻜِﺘَﺎﺏَ ﻭَﺁﺗَﻴْﻨَﺎﻩُ ﺃَﺟْﺮَﻩُ ﻓِﻲ ﺍﻟﺪُّﻧْﻴَﺎ ﻭَﺇِﻧَّﻪُ ﻓِﻲ ﺍﻟْﺂﺧِﺮَﺓِ ﻟَﻤِﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴْﻦ

‘আমরা তাকে দান করলাম ইসহাক্ব ও ইয়াকূবকে এবং তার বংশধরগণের মধ্যে প্রদান করলাম নবুঅত ও কিতাব। তাকে আমরা দুনিয়াতে পুরষ্কৃত করলাম। নিশ্চয়ই পরকালে সে সৎ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আনকাবূত ২৯/২৭)।
অতঃপর শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
ﻟَﻘَﺪْ ﻛَﺎﻥَ ﻟَﻜُﻢْ ﻓِﻲ ﺭَﺳُﻮْﻝِ ﺍﻟﻠﻪِ ﺃُﺳْﻮَﺓٌ ﺣَﺴَﻨَﺔٌ ﻟِّﻤَﻦْ ﻛَﺎﻥَ ﻳَﺮْﺟُﻮ ﺍﻟﻠﻪَ ﻭَﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ﺍﻟْﺂﺧِﺮَ ﻭَﺫَﻛَﺮَ
‘যারা আল্লাহ ও শেষদিবসের (অর্থাৎ আখেরাতে মুক্তির) আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক হারে স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের (মুহাম্মাদের) মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে’ (আহযাব ৩৩/২১)। অতঃপর তাঁর পরিবার সম্পর্কে বলা হয়েছে,
ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﻳُﺮِﻳْﺪُ ﺍﻟﻠﻪُ ﻟِﻴُﺬْﻫِﺐَ ﻋَﻨْﻜُﻢُ ﺍﻟﺮِّﺟْﺲَ ﺃَﻫْﻞَ ﺍﻟْﺒَﻴْﺖِ ﻭَﻳُﻄَﻬِّﺮَﻛُﻢْ ﺗَﻄْﻬِﻴْﺮﺍً
‘হে নবী পরিবারের সদস্যগণ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে’
(আহযাব ৩৩/৩৩)। শেষ যামানায় ইমাম মাহদী আসবেন হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর বংশধরগণের মধ্য হ’তে এ বিষয়ে বহু ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[2] এইভাবে ইবরাহীম ও মুহাম্মাদের নাম পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত দিকে দিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হ’তে থাকবে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।

নবী ইবরাহীম :

আদম, ইয়াহ্ইয়া, ঈসা প্রমুখ দু’তিন জনের ব্যতিক্রম বাদে নূহ (আঃ) সহ অন্যান্য সকল নবীর ন্যায় ইবরাহীমকেও আমরা ধরে নিতে পারি যে, তিনি ৪০ বছর বয়সে নবুঅত লাভ করেন। উম্মতে মুসলিমার পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ) পশ্চিম ইরাকের বছরার নিকটবর্তী ‘বাবেল’ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এই শহরটি পরবর্তীতে সুলায়মান (আঃ)-এর সময়ে জাদুর জন্য বিখ্যাত হয় (বাক্বারাহ ২/১০২)।
এখানে তখন কালেডীয় (ﻛﻠﺪﺍﻧﻰ ) জাতি বসবাস করত। তাদের একচ্ছত্র সম্রাট ছিলেন নমরূদ। যিনি তৎকালীন পৃথিবীতে অত্যন্ত উদ্ধত ও অহংকারী সম্রাট ছিলেন। তিনি প্রায় চারশো বছর রাজত্ব করেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজে ‘উপাস্য’ হবার দাবী করেন।[3] আল্লাহ তারই মন্ত্রী ও প্রধান পুরোহিত ‘আযর’-এর ঘরে বিশ্বনেতা ও বিশ্ব সংস্কারক নবী ইবরাহীমকে মুখ্যত: কালেডীয়দের প্রতি প্রেরণ করেন। ইবরাহীমের নিজ পরিবারের মধ্যে কেবল সহধর্মিনী ‘সারা’ ও ভ্রাতুষ্পুত্র ‘লূত’ মুসলমান হন।
স্ত্রী ‘সারা’ ছিলেন আদি মাতা বিবি হাওয়ার পরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মহিলা। তিনি ১২৭ বছর বয়সে ‘হেবরনে’ মৃত্যু ববণ করেন ও সেখানেই কবরস্থ হন।
[4] সারার মৃত্যুর পরে ইবরাহীম ক্বানতূরা বিনতে ইয়াক্বতিন ও হাজূন বিনতে আমীন নামে পরপর দুজন নারীকে বিয়ে করেন এবং ৬+৫=১১টি সন্তান লাভ করেন।[5] তিনি প্রায় দু’শো বছর জীবন পান বলে কথিত আছে।
উল্লেখ্য যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ২৫টি সূরায় ২০৪টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[6] নিম্নে আমরা আয়াত সমূহ থেকে নিয়ে সাধ্যতম সাজিয়ে কাহিনী আকারে পেশ করার চেষ্টা পাব ইনশাআল্লাহ।-

সামাজিক অবস্থা:

ইবরাহীমের আবির্ভাবকালীন সময়ে কালেডীয় সমাজ শিক্ষা ও সভ্যতায় শীর্ষস্থানীয় ছিল। এমনকি তারা সৌরজগত নিয়েও গবেষণা করত। কিন্তু অসীলা পূজার রোগে আক্রান্ত হয়ে তারা আল্লাহকে পাবার জন্য বিভিন্ন মূর্তি ও তারকা সমূহের পূজা করত। হযরত ইবরাহীম উভয় ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে প্রেরিত হন।

ইবরাহীম (আঃ)-এর দাওয়াত :

সকল নবীর ন্যায় ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় কওমকে প্রথমে তাওহীদের দাওয়াত দেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
ﻭََﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴﻢَ ﺇِﺫْ ﻗَﺎﻝَ ﻟِﻘَﻮْﻣِﻪِ ﺍﻋْﺒُﺪُﻭﺍ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻭَﺍﺗَّﻘُﻮﻩُ ﺫَﻟِﻜُﻢْ ﺧَﻴْﺮٌ ﻟَّﻜُﻢْ ﺇِﻥ ﻛُﻨﺘُﻢْ ﺗَﻌْﻠَﻤُﻮﻥَ، ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭﻥَ ﻣِﻦ ﺩُﻭﻥِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺃَﻭْﺛَﺎﻧﺎً ﻭَﺗَﺨْﻠُﻘُﻮﻥَ ﺇِﻓْﻜﺎً ﺇِﻥَّ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭﻥَ ﻣِﻦ ﺩُﻭﻥِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻟَﺎ ﻳَﻤْﻠِﻜُﻮﻥَ ﻟَﻜُﻢْ ﺭِﺯْﻗﺎً ﻓَﺎﺑْﺘَﻐُﻮﺍ ﻋِﻨﺪَ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺍﻟﺮِّﺯْﻕَ ﻭَﺍﻋْﺒُﺪُﻭﻩُ ﻭَﺍﺷْﻜُﺮُﻭﺍ ﻟَﻪُ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﺗُﺮْﺟَﻌُﻮﻥَ
‘স্মরণ কর ইবরাহীমকে, যখন তিনি তার সম্প্রদায়কে বললেন, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁকে ভয় কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বুঝ’। ‘তোমরা তো আল্লাহর পরিবর্তে কেবল প্রতিমারই পূজা করছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করছ। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করছ, তারা তোমাদের রিযিকের মালিক নয়। কাজেই আল্লাহর নিকটে রিযিক তালাশ কর। তাঁর ইবাদত কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তাঁরই নিকটে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (আনকাবূত ৩৩/১৬-১৭)।
ইবরাহীম (আঃ) উক্ত দাওয়াতের মধ্যে কেবল আল্লাহর স্বীকৃতি কামনা করেননি। বরং স্বীকৃতির ফলাফল (ﺛﻤﺮﺓ ﺍﻹﻗﺮﺍﺭ) আশা করেছিলেন। অর্থাৎ তারা যেন আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে মান্য করে এবং কোন অবস্থায় তা লংঘন না করে। কেননা স্বীকৃতির বিপরীত কাজ করা তা লংঘন করার শামিল।

পিতার প্রতি :

ﻭَﺍﺫْﻛُﺮْ ﻓِﻲ ﺍﻟْﻜِﺘَﺎﺏِ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ ﺇِﻧَّﻪُ ﻛَﺎﻥَ ﺻِﺪِّﻳْﻘﺎً ﻧَّﺒِﻴًّﺎ، ﺇِﺫْ ﻗَﺎﻝَ ﻟِﺄَﺑِﻴْﻪِ ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺖِ ﻟِﻢَ ﺗَﻌْﺒُﺪُ ﻣَﺎ ﻻَ ﻳَﺴْﻤَﻊُ ﻭَﻻَ ﻳُﺒْﺼِﺮُ ﻭَﻻَ ﻳُﻐْﻨِﻲ ﻋَﻨﻚَ ﺷَﻴْﺌﺎً، ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺖِ ﺇِﻧِّﻲ ﻗَﺪْ ﺟَﺎﺀﻧِﻲْ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻌِﻠْﻢِ ﻣَﺎ ﻟَﻢْ ﻳَﺄْﺗِﻚَ ﻓَﺎﺗَّﺒِﻌْﻨِﻲْ ﺃَﻫْﺪِﻙَ ﺻِﺮَﺍﻃﺎً ﺳَﻮِﻳّﺎً، ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺖِ ﻻَ ﺗَﻌْﺒُﺪِ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥَ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥَ ﻛَﺎﻥَ ﻟِﻠﺮَّﺣْﻤَﻦِ ﻋَﺼِﻴّﺎً، ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺖِ ﺇِﻧِّﻲْ ﺃَﺧَﺎﻑُ ﺃَﻥ ﻳَﻤَﺴَّﻚَ ﻋَﺬَﺍﺏٌ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﺮَّﺣْﻤَﻦ ﻓَﺘَﻜُﻮْﻥَ ﻟِﻠﺸَّﻴْﻄَﺎﻥِ ﻭَﻟِﻴّﺎً
‘তুমি এই কিতাবে ইবরাহীমের কথা বর্ণনা কর। নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন সত্যবাদী ও নবী’(১৯/৪১)। ‘যখন তিনি তার পিতাকে বললেন, হে আমার পিতা! তুমি তার পূজা কেন কর, যে শোনে না, দেখে না এবং তোমার কোন উপকারে আসে না?(৪২)। ‘হে আমার পিতা! আমার কাছে এমন জ্ঞান এসেছে, যা তোমার কাছে আসেনি। অতএব তুমি আমার অনুসরণ কর। আমি তোমাকে সরল পথ দেখাব’(৪৩)। ‘হে আমার পিতা! শয়তানের পূজা করো না। নিশ্চয়ই শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য’(৪৪)। ‘হে আমার পিতা! আমি আশংকা করছি যে, দয়াময়ের একটি আযাব তোমাকে স্পর্শ করবে, অতঃপর তুমি শয়তানের বন্ধু হয়ে যাবে’ (মারিয়াম ১৯/৪১-৪৫)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
ﻭَﺇِﺫْ ﻗَﺎﻝَ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢُ ﻷَﺑِﻴْﻪِ ﺁﺯَﺭَ ﺃَﺗَﺘَّﺨِﺬُ ﺃَﺻْﻨَﺎﻣﺎً ﺁﻟِﻬَﺔً ﺇِﻧِّﻲْ ﺃَﺭَﺍﻙَ ﻭَﻗَﻮْﻣَﻚَ ﻓِﻲْ ﺿَﻼَﻝٍ ﻣُّﺒِﻴْﻦٍ
‘স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম তার পিতা আযরকে বললেন, তুমি কি প্রতিমা সমূহকে উপাস্য মনে কর? আমি দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি ও তোমার সম্প্রদায় স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছ’ (আন‘আম ৬/৭৪)।
কিন্তু ইবরাহীমের এই প্রাণভরা আবেদন পিতা আযরের হৃদয় স্পর্শ করল না। রাষ্ট্রের প্রধান পুরোহিত এবং সম্রাটের মন্ত্রী ও প্রিয়পাত্র হওয়ায় সম্ভবত: বিষয়টি তার প্রেস্টিজ ইস্যু হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,

ﻭَﺇِﺫَﺍ ﻗِﻴﻞَ ﻟَﻪُ ﺍﺗَّﻖِ ﺍﻟﻠّﻪَ ﺃَﺧَﺬَﺗْﻪُ ﺍﻟْﻌِﺰَّﺓُ ﺑِﺎﻹِﺛْﻢِ ﻓَﺤَﺴْﺒُﻪُ ﺟَﻬَﻨَّﻢُ ﻭَﻟَﺒِﺌْﺲَ ﺍﻟْﻤِﻬَﺎﺩُ ،

‘যখন তাকে বলা হয়, আল্লাহকে ভয় কর, তখন তার সম্মান তাকে পাপে স্ফীত করে। অতএব তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। আর নিঃসন্দেহে তা হ’ল নিকৃষ্টতম ঠিকানা’ (বাক্বারাহ ২/২০৬)। বস্ত্ততঃ অহংকারীদের চরিত্র সর্বত্র ও সর্বযুগে প্রায় একই হয়ে থাকে।

পিতার জবাব :

পুত্রের আকুতিপূর্ণ দাওয়াতের উত্তরে পিতা বলল,

ﻗَﺎﻝَ ﺃَﺭَﺍﻏِﺐٌ ﺃَﻧْﺖَ ﻋَﻦْ ﺁﻟِﻬَﺘِﻲْ ﻳَﺎ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢُ ﻟَﺌِﻦ ﻟَّﻢْ ﺗَﻨْﺘَﻪِ ﻟَﺄَﺭْﺟُﻤَﻨَّﻚَ ﻭَﺍﻫْﺠُﺮْﻧِﻲْ ﻣَﻠِﻴًّﺎ

‘হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যদি তুমি বিরত না হও, তবে আমি অবশ্যই পাথর মেরে তোমার মাথা চূর্ণ করে দেব। তুমি আমার সম্মুখ হ’তে চিরতরের জন্য দূর হয়ে যাও’ (মারিয়াম ১৯/৪৬)।

ইবরাহীমের জবাব:

পিতার এই কঠোর ধমকি শুনে পুত্র ইবরাহীম বললেন,
ﻗَﺎﻝَ ﺳَﻼَﻡٌ ﻋَﻠَﻴْﻚَ ﺳَﺄَﺳْﺘَﻐْﻔِﺮُ ﻟَﻚَ ﺭَﺑِّﻲ ﺇِﻧَّﻪُ ﻛَﺎﻥَ ﺑِﻲ ﺣَﻔِﻴّﺎً، ﻭَﺃَﻋْﺘَﺰِﻟُﻜُﻢْ ﻭَﻣَﺎ ﺗَﺪْﻋُﻮﻥَ ﻣِﻦ ﺩُﻭﻥِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻭَﺃَﺩْﻋُﻮ ﺭَﺑِّﻲ ﻋَﺴَﻰ ﺃَﻻَّ ﺃَﻛُﻮﻥَ ﺑِﺪُﻋَﺎﺀ ﺭَﺑِّﻲ ﺷَﻘِﻴّﺎً
‘তোমার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক! আমি আমার পালনকর্তার নিকটে তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। নিশ্চয়ই তিনি আমার প্রতি মেহেরবান’। ‘আমি পরিত্যাগ করছি তোমাদেরকে এবং আল্লাহ ব্যতীত যাদের তোমরা পূজা কর তাদেরকে। আমি আমার পালনকর্তাকে আহবান করব। আশা করি আমার পালনকর্তাকে আহবান করে আমি বঞ্চিত হব না’ (মারিয়াম ১৯/৪৭-৪৮)।

পিতাকে ও নিজ সম্প্রদায়কে একত্রে দাওয়াত:

আল্লাহ বলেন,
ﻭَﺍﺗْﻞُ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﻧَﺒَﺄَ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ، ﺇِﺫْ ﻗَﺎﻝَ ﻟِﺄَﺑِﻴْﻪِ ﻭَﻗَﻮْﻣِﻪِ ﻣَﺎ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭْﻥَ، ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻧَﻌْﺒُﺪُ ﺃَﺻْﻨَﺎﻣﺎً ﻓَﻨَﻈَﻞُّ ﻟَﻬَﺎ ﻋَﺎﻛِﻔِﻴْﻦَ، ﻗَﺎﻝَ ﻫَﻞْ ﻳَﺴْﻤَﻌُﻮﻧَﻜُﻢْ ﺇِﺫْ ﺗَﺪْﻋُﻮْﻥَ، ﺃَﻭْ ﻳَﻨْﻔَﻌُﻮْﻧَﻜُﻢْ ﺃَﻭْ ﻳَﻀُﺮُّﻭْﻥَ، ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﺑَﻞْ ﻭَﺟَﺪْﻧَﺎ ﺁﺑَﺎﺀﻧَﺎ ﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻳَﻔْﻌَﻠُﻮْﻥَ، ﻗَﺎﻝَ ﺃَﻓَﺮَﺃَﻳْﺘُﻢ ﻣَّﺎ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭْﻥَ، ﺃَﻧﺘُﻢْ ﻭَﺁﺑَﺎﺅُﻛُﻢُ ﺍﻟْﺄَﻗْﺪَﻣُﻮْﻥَ، ﻓَﺈِﻧَّﻬُﻢْ ﻋَﺪُﻭٌّ ﻟِّﻲ ﺇِﻻَّ ﺭَﺏَّ ﺍﻟْﻌَﺎﻟَﻤِﻴْﻦَ، ﺍﻟَّﺬِﻱْ ﺧَﻠَﻘَﻨِﻲْ ﻓَﻬُﻮَ ﻳَﻬْﺪِﻳْﻦِ، ﻭَﺍﻟَّﺬِﻱْ ﻫُﻮَ ﻳُﻄْﻌِﻤُﻨِﻲْ ﻭَﻳَﺴْﻘِﻴْﻦِ، ﻭَﺇِﺫَﺍ ﻣَﺮِﺿْﺖُ ﻓَﻬُﻮَ ﻳَﺸْﻔِﻴْﻦِ، ﻭَﺍﻟَّﺬِﻱْ ﻳُﻤِﻴْﺘُﻨِﻲْ ﺛُﻢَّ ﻳُﺤْﻴِﻴْﻦِ، ﻭَﺍﻟَّﺬِﻱْ ﺃَﻃْﻤَﻊُ ﺃَﻥ ﻳَّﻐْﻔِﺮَ ﻟِﻲْ ﺧَﻄِﻴﺌَﺘِﻲْ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟﺪِّﻳْﻦِ، ﺭَﺏِّ ﻫَﺐْ ﻟِﻲْ ﺣُﻜْﻤﺎً ﻭَﺃَﻟْﺤِﻘْﻨِﻲْ ﺑِﺎﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴْﻦَ، ﻭَﺍﺟْﻌَﻞ ﻟِّﻲْ ﻟِﺴَﺎﻥَ ﺻِﺪْﻕٍ ﻓِﻲ ﺍﻟْﺂﺧِﺮِﻳْﻦَ، َﺍﺟْﻌَﻠْﻨِﻲْ ﻣِﻦ ﻭَّﺭَﺛَﺔِ ﺟَﻨَّﺔِ ﺍﻟﻨَّﻌِﻴْﻢِ، ﻭَﺍﻏْﻔِﺮْ ﻟِﺄَﺑِﻲْ ﺇِﻧَّﻪُ ﻛَﺎﻥَ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻀَّﺎﻟِّﻴْﻦَ، ﻭَﻻَ ﺗُﺨْﺰِﻧِﻲْ ﻳَﻮْﻡَ ﻳُﺒْﻌَﺜُﻮْﻥَ، ﻳَﻮْﻡَ ﻻَ ﻳَﻨﻔَﻊُ ﻣَﺎﻝٌ ﻭَّﻻَ ﺑَﻨُﻮْﻥَ، ﺇِﻻَّ ﻣَﻦْ ﺃَﺗَﻰ ﺍﻟﻠﻪَ ﺑِﻘَﻠْﺐٍ ﺳَﻠِﻴْﻢٍ، ﻭَﺃُﺯْﻟِﻔَﺖِ ﺍﻟْﺠَﻨَّﺔُ ﻟِﻠْﻤُﺘَّﻘِﻴْﻦَ، ﻭَﺑُﺮِّﺯَﺕِ ﺍﻟْﺠَﺤِﻴْﻢُ ﻟِﻠْﻐَﺎﻭِﻳْﻦَ، ﻭَﻗِﻴْﻞَ ﻟَﻬُﻢْ ﺃَﻳْﻦَ ﻣَﺎ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭْﻥَ، ﻣِﻦْ ﺩُﻭْﻥِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻫَﻞْ ﻳَﻨْﺼُﺮُﻭْﻧَﻜُﻢْ ﺃَﻭْ ﻳَﻨْﺘَﺼِﺮُﻭْﻥَ، ﻓَﻜُﺒْﻜِﺒُﻮْﺍ ﻓِﻴْﻬَﺎ ﻫُﻢْ ﻭَﺍﻟْﻐَﺎﻭُﻭْﻥَ، ﻭَﺟُﻨُﻮْﺩُ ﺇِﺑْﻠِﻴْﺲَ ﺃَﺟْﻤَﻌُﻮْﻥَ، ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻭَﻫُﻢْ ﻓِﻴْﻬَﺎ ﻳَﺨْﺘَﺼِﻤُﻮْﻥَ، ﺗَﺎﻟﻠﻪِ ﺇِﻥْ ﻛُﻨَّﺎ ﻟَﻔِﻲْ ﺿَﻼَﻝٍ ﻣُّﺒِﻴْﻦٍ، ﺇِﺫْ ﻧُﺴَﻮِّﻳْﻜُﻢ ﺑِﺮَﺏِّ ﺍﻟْﻌَﺎﻟَﻤِﻴْﻦَ، ﻭَﻣَﺎ ﺃَﺿَﻠَّﻨَﺎ ﺇِﻻَّ ﺍﻟْﻤُﺠْﺮِﻣُﻮْﻥَ، َﻣَﺎ ﻟَﻨَﺎ ﻣِﻦْ ﺷَﺎﻓِﻌِﻴْﻦَ، ﻭَﻻَ ﺻَﺪِﻳْﻖٍ ﺣَﻤِﻴْﻢٍ، ﻓَﻠَﻮْ ﺃَﻥَّ ﻟَﻨَﺎ ﻛَﺮَّﺓً ﻓَﻨَﻜُﻮْﻥَ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴْﻦَ، ﺇِﻥَّ ﻓِﻲْ ﺫَﻟِﻚَ ﻟَﺂﻳَﺔً ﻭَﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﺃَﻛْﺜَﺮُﻫُﻢ ﻣُّﺆْﻣِﻨِﻴْﻦَ
‘আর তাদেরকে ইবরাহীমের বৃত্তান্ত শুনিয়ে দিন’(শো‘আরা ২৬/৬৯)। ‘যখন সে স্বীয় পিতা ও সম্প্রদায়কে ডেকে বলল, তোমরা কিসের পূজা কর’?(৭০)। তারা বলল, আমরা প্রতিমার পূজা করি এবং সর্বদা এদেরকেই নিষ্ঠার সাথে আঁকড়ে থাকি’(৭১)। ‘সে বলল, তোমরা যখন আহবান কর, তখন তারা শোনে কি’?(৭২)। ‘অথবা তারা তোমাদের উপকার বা ক্ষতি করতে পারে কি’?(৭৩)। ‘তারা বলল, না। তবে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি, তারা এরূপই করত’(৭৪)। ইবরাহীম বলল, তোমরা কি তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখেছ, যাদের তোমরা পূজা করে আসছ’?(৭৫)। ‘তোমরা এবং তোমাদের পূর্ববর্তী পিতৃপুরুষেরা’(৭৬)। ‘তারা সবাই আমার শত্রু, বিশ্ব পালনকর্তা ব্যতীত’(৭৭)। ‘যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আমাকে পথ প্রদর্শন করেছেন’ (৭৮)। ‘যিনি আমাকে আহার দেশ ও পানীয় দান করেন’ (৭৯)। ‘যখন আমি পীড়িত হই, তখন তিনিই আমাকে আরোগ্য দান করেন’(৮০)। ‘যিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর পুনর্জীবন দান করবেন’ (৮১)। ‘আশা করি শেষ বিচারের দিন তিনি আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দিবেন’ (৮২)। ‘হে আমার পালনকর্তা! আমাকে প্রজ্ঞা দান কর এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর’(৮৩)। ‘এবং আমাকে পরবর্তীদের মধ্যে সত্যভাষী কর’ (৮৪)। ‘তুমি আমাকে নে‘মতপূর্ণ জান্নাতের উত্তরাধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর’(৮৫)। (হে প্রভু) ‘তুমি আমার পিতাকে ক্ষমা কর। তিনি তো পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত’(৮৬) (হে আল্লাহ) ‘পুনরুত্থান দিবসে তুমি আমাকে লাঞ্ছিত কর না’ (৮৭)। ‘যে দিনে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না’ (৮৮) ‘কিন্তু যে ব্যক্তি সরল হৃদয় নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে’ (৮৯)। ‘(ঐ দিন) জান্নাত আল্লাহভীরুদের নিকটবর্তী করা হবে’(৯০)। ‘এবং জাহান্নাম বিপথগামীদের সামনে উন্মোচিত করা হবে’(৯১)। ‘(ঐ দিন) তাদেরকে বলা হবে, তারা কোথায় যাদেরকে তোমরা পূজা করতে’?(৯২) ‘আল্লাহর পরিবর্তে। তারা কি (আজ) তোমাদের সাহায্য করতে পারে কিংবা তারা কি কোনরূপ প্রতিশোধ নিতে পারে’? (৯৩)। ‘অতঃপর তাদেরকে এবং (তাদের মাধ্যমে) পথভ্রষ্টদেরকে অধোমুখী করে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে’(৯৪) ‘এবং ইবলীস বাহিনীর সকলকে’ (৯৫)। ‘তারা সেখানে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে বলবে’(৯৬) ‘আল্লাহর কসম! আমরা প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে ছিলাম’(৯৭), ‘যখন আমরা তোমাদেরকে (অর্থাৎ কথিত উপাস্যদেরকে) বিশ্বপালকের সমতুল্য গণ্য করতাম’(৯৮)।‘আসলে আমাদেরকে পাপাচারীরাই পথভ্রষ্ট করেছিল’ (৯৯)। ‘ফলে (আজ) আমাদের কোন সুফারিশকারী নেই’ (১০০) ‘এবং কোন সহৃদয় বন্ধুও নেই’(১০১)। ‘হায়! যদি কোনরূপে আমরা পৃথিবীতে ফিরে যাবার সুযোগ পেতাম, তাহ’লে আমরা ঈমানদারগণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম’(১০২)। ‘নিশ্চয়ই এ ঘটনার মধ্যে নিদর্শন রয়েছে। বস্ত্ততঃ তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী ছিল না’ (১০৩)। ‘নিশ্চয়ই আপনার পালনকর্তা পরাক্রান্ত ও দয়ালু’ (শো‘আরা ২৬/৬৯-১০৪)।
স্বীয় পিতা ও সম্প্রদায়ের নিকটে ইবরাহীমের দাওয়াত ও তাদের জবাবকে আল্লাহ অন্যত্র নিম্নরূপে বর্ণনা করেন। যেমন-
ﺇِﺫْ ﻗَﺎﻝَ ﻟِﺄَﺑِﻴْﻪِ ﻭَﻗَﻮْﻣِﻪِ ﻣَﺎ ﻫَﺬِﻩِ ﺍﻟﺘَّﻤَﺎﺛِﻴْﻞُ ﺍﻟَّﺘِﻲْ ﺃَﻧْﺘُﻢْ ﻟَﻬَﺎ ﻋَﺎﻛِﻔُﻮْﻥَ، ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻭَﺟَﺪْﻧَﺎ ﺁﺑَﺎﺀﻧَﺎ ﻟَﻬَﺎ ﻋَﺎﺑِﺪِﻳْﻦَ، ﻗَﺎﻝَ ﻟَﻘَﺪْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﺃَﻧْﺘُﻢْ ﻭَﺁﺑَﺎﺅُﻛُﻢْ ﻓِﻲْ ﺿَﻼَﻝٍ ﻣُّﺒِﻴْﻦٍ، ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﺃَﺟِﺌْﺘَﻨَﺎ ﺑِﺎﻟْﺤَﻖِّ ﺃَﻡْ ﺃَﻧْﺖَ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻼَّﻋِﺒِﻴْﻦَ، ﻗَﺎﻝَ ﺑَﻞ ﺭَّﺑُّﻜُﻢْ ﺭَﺏُّ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﻭَﺍﺕِ ﻭَﺍﻟْﺄَﺭْﺽِ ﺍﻟَّﺬِﻱْ ﻓَﻄَﺮَﻫُﻦَّ ﻭَﺃَﻧَﺎ ﻋَﻠَﻰ ﺫَﻟِﻜُﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﺸَّﺎﻫِﺪِﻳْﻦَ، ﻭَﺗَﺎﻟﻠﻪِ ﻟَﺄَﻛِﻴْﺪَﻥَّ ﺃَﺻْﻨَﺎﻣَﻜُﻢ ﺑَﻌْﺪَ ﺃَﻥ ﺗُﻮَﻟُّﻮْﺍ ﻣُﺪْﺑِﺮِﻳْﻦَ
ইবরাহীম স্বীয় পিতা ও সম্প্রদায়কে বলল, ‘এই মূর্তিগুলি কী যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ’?(আম্বিয়া ২১/৫২)। ‘তারা বলল, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এরূপ পূজা করতে দেখেছি’(৫৩)। ‘সে বলল, তোমরা প্রকাশ্য গুমরাহীতে লিপ্ত আছ এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও’ (৫৪)। ‘তারা বলল, তুমি কি আমাদের কাছে সত্যসহ এসেছ, না কেবল কৌতুক করছ’? (৫৫)। ‘সে বলল, না। তিনিই তোমাদের পালনকর্তা, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের পালনকর্তা, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন এবং আমি এ বিষয়ে তোমাদের উপর অন্যতম সাক্ষ্যদাতা’(৫৬)। ‘আল্লাহর কসম! যখন তোমরা ফিরে যাবে, তখন আমি তোমাদের মূর্তিগুলোর ব্যাপারে একটা কিছু করে ফেলব’ (আম্বিয়া ২১/৫২-৫৭)।

দাওয়াতের সারকথা ও ফলশ্রুতি :

মূর্তিপূজারী পিতা ও সম্প্রদায়ের নেতাদের নিকটে ইবরাহীমের দাওয়াত ও তাদের প্রদত্ত জবাবের সার কথাগুলি নিম্নরূপ:
১. ইবরাহীম তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে দাওয়াত দেন। তিনি মূর্তি পূজার অসারতার বিষয়টি তাদের সামনে বলে দেন। কেননা এটি ছিল সকলের সহজবোধ্য। কিন্তু তারা মূর্তিপূজার অসীলা ছাড়তে রাযী হয়নি। কারণ শিরকী প্রথার মধ্যে নেতাদের লাভ ছিল মাল-সম্পদ ও দুনিয়াবী সম্মানের নগদ প্রাপ্তি। পক্ষান্তরে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে এসবের প্রাপ্তি যোগ নেই। শিরকী পূজা-পার্বনের মধ্যে গরীবদের লাভ ছিল এই যে, এর ফলে তারা নেতাদের কাছ থেকে দুনিয়াবী সহযোগিতা পেত। এ ছাড়াও বিভিন্ন কাল্পনিক ও ভ্রান্ত বিশ্বাস তাদেরকে মূর্তিপূজায় প্ররোচিত করত। পক্ষান্তরে একনিষ্ঠ তাওহীদ বিশ্বাস তাদেরকে এসব থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। যেখানে এক আল্লাহর গোলামীর অধীনে বড়-ছোট সবার জন্য সামাজিক সমানাধিকার নিশ্চিত হয়ে যায়।
২. মূর্তিপূজারীদের কোন সঙ্গত জবাব ছিল না। তারা কেবল একটা কথাই বলেছিল যে, এটা আমাদের বাপ-দাদাদের আমল থেকে চলে আসা প্রথা।
৩. ইবরাহীমের এত কিছু বক্তব্যের পরেও এই অন্ধপূজারীরা বলল, আসলেই তুমি কোন সত্য এনেছ, না আমাদের সাথে কৌতুক করছ? কারণ অদৃশ্য অহীর বিষয়টি তাদের বাস্তব জ্ঞানে আসেনি। কিন্তু মূর্তিকে তারা সামনে দেখতে পায়। সেখানে সেবা ও পূজা করে তারা তৃপ্তি পায়।
৪. পিতা তাঁকে মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার হুমকি দিল এবং বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিল। কিন্তু তিনি পিতার জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনার ওয়াদা করলেন। এর মধ্যে পিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য বোধ ফুটে উঠেছে, যদিও তিনি মুশরিক হন। পরে পিতার কুফরী পরিষ্কার হয়ে গেলে তিনি বিরত হন (তওবাহ ৯/১১৪)।
৫. পিতা বহিষ্কার করলেও সম্প্রদায় তখনও বহিষ্কার করেনি। তাই তিনি পুনরায় দাওয়াতে মনোনিবেশ করলেন। যদিও তার ফলশ্রুতি ছিল পূর্বের ন্যায় শূন্য।

তারকা পূজারীদের সাথে বিতর্ক :

মূর্তি পূজারীদের সাথে বিতর্কের পরে তিনি তারকাপূজারী নেতাদের প্রতি তাওহীদের দাওয়াত দেন। কিন্তু তারাও মূর্তি পূজারীদের ন্যায় নিজ নিজ বিশ্বাসে অটল রইল। অবশেষে তাঁর সাথে তাদের নেতাদের তর্কযুদ্ধ আবশ্যিক হয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলেছেন, ইবরাহীমের কওমের লোকেরা একই সাথে মূর্তি ও তারকার পূজা করত। সেটাও অসম্ভব কিছু নয়।
পবিত্র কুরআনে এই তর্কযুদ্ধ একটি অভিনব ও নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে সহজে আরবীয় পাঠক হৃদয়ে রেখাপাত করে। কেননা হযরত ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন সমগ্র আরবের লোকদের পিতামহ। তাঁর প্রতি গোটা আরব জাতি সম্মান প্রদর্শন করত। অথচ তাদের পিতামহ যার বিরুদ্ধে জীবনভর লড়াই করলেন জাহিল আরবরা সেই সব শিরকে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। যে কা‘বা গৃহকে ইবরাহীম (আঃ) নির্মাণ করেন এক আল্লাহর ইবাদতের জন্য। তারা সেখানেই মূর্তিপূজা শুরু করে দিয়েছিল। অথচ মুখে আল্লাহকে স্বীকার করত এবং ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করত। আজকের মুসলমানদের জন্য এর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। কেননা তারাও মুখে আল্লাহকে স্বীকার করে এবং শেষনবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে। অথচ নিজেরা কবর পূজা ও স্থানপূজার শিরকে লিপ্ত রয়েছে। আল্লাহর বিধানের অবাধ্যতা ও তার পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া বিধান সমূহের আনুগত্য তো রয়েছেই। এক্ষণে আমরা কুরআনে বর্ণিত ইবরাহীমের অপর বিতর্ক যুদ্ধটির বিবরণ পেশ করব।-
আল্লাহ বলেন,
ﻭَﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻧُﺮِﻱْ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ ﻣَﻠَﻜُﻮْﺕَ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﻭَﺍﺕِ ﻭَﺍﻷَﺭْﺽِ ﻭَﻟِﻴَﻜُﻮْﻥَ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤُﻮْﻗِﻨِﻴْﻦَ، ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺟَﻦَّ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﺍﻟﻠَّﻴْﻞُ ﺭَﺃَﻯ ﻛَﻮْﻛَﺒﺎً ﻗَﺎﻝَ ﻫَـﺬَﺍ ﺭَﺑِّﻲ ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺃَﻓَﻞَ ﻗَﺎﻝَ ﻻ ﺃُﺣِﺐُّ ﺍﻵﻓِﻠِﻴْﻦَ، ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺭَﺃَﻯ ﺍﻟْﻘَﻤَﺮَ ﺑَﺎﺯِﻏﺎً ﻗَﺎﻝَ ﻫَـﺬَﺍ ﺭَﺑِّﻲْ ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺃَﻓَﻞَ ﻗَﺎﻝَ ﻟَﺌِﻦ ﻟَّﻢْ ﻳَﻬْﺪِﻧِﻲْ ﺭَﺑِّﻲ ﻟَﺄَﻛُﻮْﻧَﻦَّ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡِ ﺍﻟﻀَّﺂﻟِّﻴْﻦَ، ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺭَﺃَﻯ ﺍﻟﺸَّﻤْﺲَ ﺑَﺎﺯِﻏَﺔً ﻗَﺎﻝَ ﻫَـﺬَﺍ ﺭَﺑِّﻲْ ﻫَـﺬَﺍ ﺃَﻛْﺒَﺮُ ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺃَﻓَﻠَﺖْ ﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﻗَﻮْﻡِ ﺇِﻧِّﻲْ ﺑَﺮِﻱﺀٌ ﻣِّﻤَّﺎ ﺗُﺸْﺮِﻛُﻮْﻥَ، ﺇِﻧِّﻲ ﻭَﺟَّﻬْﺖُ ﻭَﺟْﻬِﻲَ ﻟِﻠَّﺬِﻱْ ﻓَﻄَﺮَ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﻭَﺍﺕِ ﻭَﺍﻷَﺭْﺽَ ﺣَﻨِﻴْﻔﺎً ﻭَّﻣَﺎ ﺃَﻧَﺎْ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤُﺸْﺮِﻛِﻴْﻦَ، ﻭَﺣَﺂﺟَّﻪُ ﻗَﻮْﻣُﻪُ ﻗَﺎﻝَ ﺃَﺗُﺤَﺎﺟُّﻮﻧِّﻲ ﻓِﻲ ﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﻗَﺪْ ﻫَﺪَﺍﻥِ ﻭَﻻَ ﺃَﺧَﺎﻑُ ﻣَﺎ ﺗُﺸْﺮِﻛُﻮْﻥَ ﺑِﻪِ ﺇِﻻَّ ﺃَﻥ ﻳَّﺸَﺂﺀَ ﺭَﺑِّﻲْ ﺷَﻴْﺌﺎً ﻭَﺳِﻊَ ﺭَﺑِّﻲْ ﻛُﻞَّ ﺷَﻲْﺀٍ ﻋِﻠْﻤﺎً ﺃَﻓَﻼَ ﺗَﺘَﺬَﻛَّﺮُﻭْﻥَ، ﻭَﻛَﻴْﻒَ ﺃَﺧَﺎﻑُ ﻣَﺎ ﺃَﺷْﺮَﻛْﺘُﻢْ ﻭَﻻَ ﺗَﺨَﺎﻓُﻮْﻥَ ﺃَﻧَّﻜُﻢْ ﺃَﺷْﺮَﻛْﺘُﻢْ ﺑِﺎﻟﻠّﻪِ ﻣَﺎ ﻟَﻢْ ﻳُﻨَﺰِّﻝْ ﺑِﻪِ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﺳُﻠْﻄَﺎﻧﺎً ﻓَﺄَﻱُّ ﺍﻟْﻔَﺮِﻳْﻘَﻴْﻦِ ﺃَﺣَﻖُّ ﺑِﺎﻷَﻣْﻦِ ﺇِﻥْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﺗَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ، ﺍﻟَّﺬِﻳْﻦَ ﺁﻣَﻨُﻮﺍ ﻭَﻟَﻢْ ﻳَﻠْﺒِﺴُﻮْﺍ ﺇِﻳﻤَﺎﻧَﻬُﻢْ ﺑِﻈُﻠْﻢٍ ﺃُﻭﻟَـﺌِﻚَ ﻟَﻬُﻢُ ﺍﻷَﻣْﻦُ ﻭَﻫُﻢ ﻣُّﻬْﺘَﺪُﻭْﻥَ
‘আমি এরূপভাবেই ইবরাহীমকে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অত্যাশ্চর্য বস্ত্তসমূহ দেখাতে লাগলাম, যাতে সে দৃঢ়বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়’ (আন‘আম ৬/৭৫)। ‘অনন্তর যখন রাত্রির অন্ধকার তার উপরে সমাচ্ছন্ন হ’ল, তখন সে তারকা দেখে বলল যে, এটি আমার পালনকর্তা। অতঃপর যখন তা অস্তমিত হ’ল, তখন বলল, আমি অস্তগামীদের ভালবাসি না’ (৭৬)। ‘অতঃপর যখন চন্দ্রকে ঝলমল করতে দেখল, তখন সে বলল, এটি আমার পালনকর্তা। কিন্তু পরে যখন তা অস্তমিত হ’ল, তখন বলল, যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথ প্রদর্শন না করেন, তাহ’লে অবশ্যই আমি পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (৭৭)। ‘অতঃপর যখন উদীয়মান সূর্যকে ডগমগে দেখতে পেল, তখন বলল, এটিই আমার পালনকর্তা এবং এটিই সবচেয়ে বড়। কিন্তু পরে যখন তা ডুবে গেল, তখন বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেসব বিষয়কে শরীক কর, আমি ওসব থেকে মুক্ত’ (৭৮)। ‘আমি আমার চেহারাকে ঐ সত্তার দিকে একনিষ্ঠ করছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (৭৯)। ‘(তখন) তার সম্প্রদায় তার সাথে বিতর্ক করল। সে বলল, তোমরা কি আমার সাথে আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করছ? অথচ তিনি আমাকে সরল পথ দেখিয়েছেন। আর আমি ভয় করিনা তাদের, যাদেরকে তোমরা তাঁর সাথে শরীক কর, তবে আমার পালনকর্তা যদি কিছু (কষ্ট দিতে) চান। আমার প্রভুর জ্ঞান সবকিছুতেই পরিব্যপ্ত। তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না’? (৮০)। ‘কিভাবে আমি ঐসব বস্ত্তকে ভয় করব, যাদেরকে তোমরা তাঁর সাথে শরীক করেছ? অথচ তোমরা এ বিষয়ে ভয় পাওনা যে, তোমরা আল্লাহর সাথে এমন সব বস্ত্তকে শরীক করেছ, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদের প্রতি কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। এক্ষণে উভয় দলের মধ্যে কে বেশী নিরাপত্তা লাভের অধিকারী? যদি তোমরা জ্ঞানী হয়ে থাক’ (৮১)। ‘যারা ঈমান আনে এবং স্বীয় ঈমানকে শিরকের সাথে মিশ্রিত করে না, তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই হ’ল সুপথপ্রাপ্ত’ (আন‘আম ৬/৭৫-৮২)।
উপরের বর্ণনা ভঙ্গিতে মনে হয় যেন ইবরাহীম ঐ দিনই প্রথম নক্ষত্র, চন্দ্র ও সূর্য দেখলেন এবং ‘এটি আমার পালনকর্তা’ বলে সাময়িকভাবে মুশরিক হয়েছিলেন। পরে শিরক পরিত্যাগ করে মুসলিম হ’লেন। অথচ ঘটনা মোটেই তা নয়। কেননা ঐ সময় ইবরাহীম (আঃ) অন্যূন সত্তরোর্ধ্ব বয়সের নবী। আর নবীগণ জন্ম থেকেই নিষ্পাপ ও শিরকমুক্ত থাকেন। আসল কথা হ’ল এই যে, মূর্তি পূজার অসারতা বুঝানো যতটা সহজ ছিল, তারকা পূজার অসারতা বুঝানো ততটা সহজ ছিল না। কেননা ওটা মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই ইবরাহীম (আঃ) এখানে বৈজ্ঞানিক পন্থা বেছে নিলেন এবং জনগণের সহজবোধ্য এমন একটি প্রমাণ উপস্থাপন করলেন, যাতে তাদের লা-জওয়াব হওয়া ব্যতীত কোন উপায় ছিল না। তিনি সৌরজগতের গতি-প্রকৃতি যে আল্লাহর হুকুমের অধীন, সে কথা না বলে তাদের অস্তমিত হওয়ার বিষয়টিকে প্রমাণ হিসাবে পেশ করেন। কারণ এটাই ছিল তাদের জন্যে সহজবোধ্য। তিনি বলেন, যা ক্ষয়ে যায়, ডুবে যায়, হারিয়ে যায়, নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারে না, ধরে রাখতে পারে না, বরং দৈনিক ওঠে আর ডোবে, সে কখনো মানুষের প্রতিপালক হ’তে পারে না। বরং সর্বোচ্চ পালনকর্তা কেবল তিনিই হ’তে পারেন, যিনি এসব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও বিধানদাতা। আর তিনিই হ’লেন ‘আল্লাহ’। আমি তাঁর দিকেই ফিরে গেলাম এবং বাপ-দাদার আমল থেকে তোমরা যে শিরক করে আসছ, আমি তা থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করলাম।
বলা বাহুল্য, এর অন্তর্নিহিত দাওয়াত ছিল এই যে, হে আমার জাতি! তোমরাও আমার মত আল্লাহর দিকে ফিরে এসো এবং শিরক হ’তে মুক্ত হও। কিন্তু ইবরাহীমের এই তর্কযুদ্ধ নিষ্ফল হ’ল। সম্প্রদায়ের নেতারা নিজ নিজ মতের উপরে দৃঢ় রইল। কেউ তাঁর আহবানে সাড়া দিল না।

একটি সংশয় ও তার জওয়াব :

৭৫ হ’তে ৮২ পর্যন্ত ৮টি আয়াতে যে বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে, এটি ইবরাহীমের শিশুকালে জ্ঞান-বুদ্ধির বয়স হবার সময়কার ঘটনা, নাকি নবী হবার পরের তর্কানুষ্ঠান, এ বিষয়ে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। ইবনু জারীর (মৃঃ ৩১০ হিঃ) প্রথমোক্ত মত পোষণ করেন। তিনি এ বিষয়ে আলী ইবনে ত্বালহার সূত্রে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনা পেশ করেছেন। তবে এই বর্ণনাটির সনদ যঈফ।[7]
মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব (৮৫-১৫০ হিঃ) বর্ণিত কিছু অলৌকিক ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে, যা উক্ত মতকে সমর্থন করে। যেমন বাদশাহ নমরূদ যখন জানতে পারেন যে, অচিরেই একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করবে, যে তার রাজ্য হারানোর কারণ হবে, তখন তিনি নবজাতক সকল পুত্র সন্তানকে হত্যা করার নির্দেশ জারি করেন। ইবরাহীমের মা তখন একটি পাহাড়ের গোপন গুহায় লুকিয়ে ইবরাহীমকে প্রসব করেন এবং ইবরাহীম একাকী সেখানে বড় হন। ইবরাহীমের এক আঙ্গুল দিয়ে দুধ বের হ’ত, এক আঙ্গুল দিয়ে মধু বের হ’ত ও এক আঙ্গুল দিয়ে পানি বের হ’ত। এভাবে তিনি সেখানে তিন বছর কাটান। তারপর তিনি সেখান থেকে বের হয়ে এসে মাকে বলেন, আমার প্রভু কে? মা বললেন, নমরূদ। তিনি বললেন, নমরূদের প্রভু কে? তখন মা তাকে চড় মারলেন এবং তিনি বুঝলেন এটিই হ’ল সেই ছেলে, যার সম্পর্কে বাদশাহ নমরূদ আগেই স্বপ্ন দেখেছেন। সুদ্দী, যাহহাক প্রমুখের বরাতে কাসাঈ স্বীয় ক্বাছাছুল আম্বিয়ার মধ্যে এ ধরনের অনেক অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করেছেন (ইবনু কাছীর, কুরতুবী)। অতঃপর ইবরাহীম গুহা থেকে বের হয়ে প্রথম তারকা দেখলেন, তারপর চন্দ্র দেখলেন, তারপর সূর্য দেখলেন। অতঃপর সবকিছুর ডুবে যাওয়া দেখে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, প্রকৃত পালনকর্তা তিনি, যিনি এগুলিকে সৃষ্টি করেছেন (কুরতুবী)। ইবনু জারীর দলীল এনেছেন ইবরাহীমের একথা দ্বারা, যেখানে তিনি বলেছেন, ﻟَﺌِﻦ ﻟَّﻢْ ﻳَﻬْﺪِﻧِﻲ ﺭَﺑِّﻲ ﻷﻛُﻮﻧَﻦَّ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡِ ﺍﻟﻀَّﺎﻟِّﻴﻦَ ، ‘যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথ না দেখান, তাহ’লে অবশ্যই আমি পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (আন‘আম ৬/৭৭)।
ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ) বলেন, বরং সঠিক কথা এই যে, ইবরাহীমের উপরোক্ত ঘটনা ছিল তার কওমের সাথে একটি তর্কানুষ্ঠান মাত্র। এটি কখনোই তার শিশুকালের ঘটনা নয় এবং তিনি ক্ষণিকের তরেও কখনো মুশরিক হননি। কেননা তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ﺇِﻥَّ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴﻢَ ﻛَﺎﻥَ ﺃُﻣَّﺔً ﻗَﺎﻧِﺘﺎً ﻟِﻠّﻪِ ﺣَﻨِﻴﻔﺎً ﻭَﻟَﻢْ ﻳَﻚُ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤُﺸْﺮِﻛِﻴﻦَ ، ‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন একটি উম্মত এবং আল্লাহর প্রতি অনুগত ও একনিষ্ঠ। আর তিনি কখনোই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’ (নাহল ১৬/১২০)। তাছাড়া প্রত্যেক মানব শিশুই জন্মগতভাবে আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, ﺧَﻠَﻘْﺖُ ﻋﺒﺎﺩﻯ ﺣُﻨَﻔَﺎﺀَ ‘আমি আমার বান্দাদের সৃষ্টি করি আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হিসাবে’।[8] সাধারণ মানবশিশু যদি এরূপ হয়, তাহ’লে শিশু ইবরাহীম কেন মুশরিক হবেন? আর এটা যে কওমের নেতাদের সাথে তাঁর একটি তর্কানুষ্ঠান ছিল, তার বড় প্রমাণ এই যে, ৮০ নং আয়াতে বলা হয়েছে ﻭَﺣَﺂﺟَّﻪُ ﻗَﻮْﻣُﻪُ ‘তাঁর কওম তাঁর সাথে বিতর্ক করল’। তাছাড়া তর্ক শেষে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ﻳَﺎ ﻗَﻮْﻡِ ﺇِﻧِّﻲ ﺑَﺮِﻱﺀٌ ﻣِّﻤَّﺎ ﺗُﺸْﺮِﻛُﻮﻥَ ،

‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেসব বিষয়কে শরীক কর, আমি ওসব থেকে মুক্ত’ (আন‘আম ৬/৭৮)।
বলা বাহুল্য তারকা পূজারী নেতাদের সাথে ইবরাহীম (আঃ)-এর বিতর্কের ঘটনাটি কুরআন অত্যন্ত উঁচুমানের আলংকরিক ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছে, যা একটি বাস্তব ও অতুলনীয় বাণীচিত্রের রূপ ধারণ করেছে। যেমন ইবরাহীম (আঃ) উক্ত নেতাদের বলছেন, তোমাদের ধারণা অনুযায়ী ধরে নিলাম আকাশের ঐ  নক্ষত্র,  চন্দ্র ও সূর্য সকলেই ‘আমার রব’। কিন্তু ওরা যে ডুবে গেল। যারা নিজেরা ডুবে যায়, তারা আমাকে বা তোমাদেরকে কিভাবে রক্ষা করবে? অতএব আমি তোমাদের শিরকী আক্বীদা হ’তে মুক্ত। আমি এদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ ও অনুগত রইলাম। তোমরাও এদিকে ফিরে এসো। যেমন ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ মুশরিকদের ডেকে বলবেন,

ﺃَﻳْﻦَ ﺷُﺮَﻛَﺎﺋِﻲَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻛُﻨﺘُﻢْ ﺗَﺰْﻋُﻤُﻮﻥَ

‘তোমাদের ধারণা অনুযায়ী আমার শরীকরা কোথায়?
(ক্বাছাছ ২৮/৬২)। অর্থাৎ তোমাদের দাবী অনুযায়ী ওরা আমার শরীক। অথচ আল্লাহর কোন শরীক নেই।

ইবরাহীম মূর্তি ভাঙ্গলেন :

জ্ঞানীদের ইশারাই যথেষ্ট। কিন্তু মানুষ যখন কোন কিছুর প্রতি অন্ধভক্তি পোষণ করে, তখন শত যুক্তিও কোন কাজ দেয় না। ফলে ইবরাহীম ভাবলেন, এমন কিছু একটা করা দরকার, যাতে পুরা সমাজ নড়ে ওঠে ও ওদের মধ্যে হুঁশ ফিরে আসে। সাথে সাথে তাদের মধ্যে তাওহীদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। সেমতে তিনি সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় দেবমন্দিরে গিয়ে মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলার সংকল্প করলেন।
ইবরাহীম (আঃ)-এর সম্প্রদায় বছরের একটা বিশেষ দিনে উৎসব পালন করত ও সেখানে নানারূপ অপচয় ও অশোভন কাজ করত। যেমন আজকাল প্রবৃত্তি পূজারী ও বস্ত্তবাদী লোকেরা করে থাকে কথিত সংস্কৃতির নামে। এইসব মেলায় সঙ্গত কারণেই কোন নবীর যোগদান করা সম্ভব নয়। কওমের লোকেরা তাকে উক্ত মেলায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানালো। কিন্তু তিনি অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে সেখানে যেতে অপারগতা প্রকাশ করলেন (ছাফফাত ৩৭/৮৯)। অতঃপর তিনি ভাবলেন, আজকের এই সুযোগে আমি ওদের দেবমন্দিরে প্রবেশ করে মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেব। যাতে ওরা ফিরে এসে ওদের মিথ্যা উপাস্যদের অসহায়ত্বের বাস্তব দৃশ্য দেখতে পায়। হয়তবা এতে তাদের অনেকের মধ্যে হুঁশ ফিরবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান জাগ্রত হবে ও শিরক থেকে তওবা করবে।
অতঃপর তিনি দেবালয়ে ঢুকে পড়লেন ও দেব-দেবীদের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, (তোমাদের সামনে এত নযর-নেয়ায ও ভোগ-নৈবেদ্য রয়েছে)। অথচ ‘তোমরা তা খাচ্ছ না কেন? কি ব্যাপার তোমরা কথা বলছ না কেন? তারপর তিনি ডান হাতে রাখা (সম্ভবতঃ কুড়াল দিয়ে) ভীষণ জোরে আঘাত করে সবগুলোকে গুঁড়িয়ে দিলেন (ছাফফাত ৩৭/৯১-৯৩)। তবে বড় মূর্তিটাকে পূর্বাবস্থায় রেখে দিলেন, যাতে লোকেরা তার কাছে ফিরে যায় (আম্বিয়া ২১/৫৮)।
মেলা শেষে লোকজন ফিরে এল এবং যথারীতি দেবমন্দিরে গিয়ে প্রতিমাগুলির অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গেল। ‘তারা বলাবলি করতে লাগল, এটা নিশ্চয়ই ইবরাহীমের কাজ হবে। কেননা তাকেই আমরা সবসময় মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে বলতে শুনি। অতঃপর ইবরাহীমকে সেখানে ডেকে আনা হ’ল এবং জিজ্ঞেস করল, ﺃَﺃَﻧﺖَ ﻓَﻌَﻠْﺖَ ﻫَﺬَﺍ ﺑِﺂﻟِﻬَﺘِﻨَﺎ ﻳَﺎ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴﻢُ؟ ‘হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ আচরণ করেছ’? (আম্বিয়া ২১/৬২)।
ইবরাহীম বললেন, ﺑَﻞْ ﻓَﻌَﻠَﻪُ ﻛَﺒِﻴﺮُﻫُﻢْ ﻫَﺬَﺍ ﻓَﺎﺳْﺄَﻟُﻮﻫُﻢْ ﺇِﻥْ ﻛَﺎﻧُﻮﺍ ﻳَﻨْﻄِﻘُﻮْﻥَ – ‘বরং এই বড় মূর্তিটাই একাজ করেছে। নইলে এদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তারা কথা বলতে পারে’ (আম্বিয়া ২১/৬৩)। সম্প্রদায়ের নেতারা একথা শুনে লজ্জা পেল এবং মাথা নীচু করে বলল, ﻗَﺪْ ﻋَﻠِﻤْﺖَ ﻣَﺎ ﻫَﺆُﻻَﺀ ﻳَﻨْﻄِﻘُﻮْﻥَ – ‘তুমি তো জানো যে, এরা কথা বলে না’। ‘তিনি বললেন, ﻗَﺎﻝَ ﺃَﻓَﺘَﻌْﺒُﺪُﻭْﻥَ ﻣِﻦْ ﺩُﻭْﻥِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻣَﺎ ﻻَ ﻳَﻨﻔَﻌُﻜُﻢْ ﺷَﻴْﺌﺎً ﻭَّﻻَ ﻳَﻀُﺮُّﻛُﻢْ – ‘তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর, যা তোমাদের উপকারও করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না’ (আম্বিয়া ২১/৬৫-৬৬)। তিনি আরও বললেন,ﻗَﺎﻝَ ﺃَﺗَﻌْﺒُﺪُﻭﻥَ ﻣَﺎ ﺗَﻨْﺤِﺘُﻮﻥَ، ﻭَﺍﻟﻠﻪ ﺧَﻠَﻘَﻜُﻢْ ﻭَﻣَﺎ ﺗَﻌْﻤَﻠُﻮﻥَ-  ‘তোমরা এমন বস্ত্তর পূজা কর, যা তোমরা নিজ হাতে তৈরী কর’? ‘অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে ও তোমাদের কর্মসমূহকে সৃষ্টি করেছেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৫-৯৬)

। ﺃُﻑٍّ ﻟَّﻜُﻢْ ﻭَﻟِﻤَﺎ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭﻥَ ﻣِﻦْ

ﺩُﻭﻥِ ﺍﻟﻠﻪِ ﺃَﻓَﻼَ ﺗَﻌْﻘِﻠُﻮﻥَ

‘ধিক তোমাদের জন্য এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যাদের পূজা কর, ওদের জন্য। তোমরা কি বুঝ না’? (আম্বিয়া ২১/৬৭)।
তারপর যা হবার তাই হ’ল। যিদ ও অহংকারের বশবর্তী হয়ে সম্প্রদায়ের নেতারা ইবরাহীমকে চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করল। তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, একে আর বাঁচতে দেওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, একে এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে মারতে হবে, যেন কেউ এর দলে যেতে সাহস না করে। তারা তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার প্রস্তাব গ্রহণ করল এবং সেটা বাদশাহ নমরূদের কাছে পেশ করল। সম্রাটের মন্ত্রী ও দেশের প্রধান পুরোহিতের ছেলে ইবরাহীম। অতএব তাকে সরাসরি সম্রাটের দরবারে আনা হ’ল।

নমরূদের সঙ্গে বিতর্ক ও অগ্নিপরীক্ষা :

ইবরাহীম (আঃ) এটাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তাওহীদের দাওয়াত দেওয়ার সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করলেন। নমরূদ ৪০০ বছর ধরে রাজত্ব করায় সে উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে উঠেছিল এবং নিজেকে একমাত্র উপাস্য ভেবেছিল। তাই সে ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করল, বল তোমার উপাস্য কে? নমরূদ ভেবেছিল, ইবরাহীম তাকেই উপাস্য বলে স্বীকার করবে। কিন্তু নির্ভীক কণ্ঠে ইবরাহীম জবাব দিলেন, ﺭَﺑِّﻲَ ﺍﻟَّﺬِﻱْ ﻳُﺤْﻴِـﻲْ ﻭَﻳُﻤِﻴْﺖُ ‘আমার পালনকর্তা তিনি, যিনি মানুষকে বাঁচান ও মারেন’। মোটাবুদ্ধির নমরূদ বলল, ﺃَﻧَﺎ ﺃُﺣْﻴِـﻲْ ﻭَﺃُﻣِﻴْﺖُ ‘আমিও বাঁচাই ও মারি’। অর্থাৎ মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে খালাস দিয়ে মানুষকে বাঁচাতে পারি। আবার খালাসের আসামীকে মৃত্যুদন্ড দিতে পারি। এভাবে সে নিজেকেই মানুষের বাঁচা-মরার মালিক হিসাবে সাব্যস্ত করল। ইবরাহীম তখন দ্বিতীয় যুক্তি পেশ করে বললেন, ﻓَﺈِﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻳَﺄْﺗِﻲْ ﺑِﺎﻟﺸَّﻤْﺲِ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤَﺸْﺮِﻕِ ﻓَﺄْﺕِ ﺑِﻬَﺎ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤَﻐْﺮِﺏِ ‘আমার আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন, আপনি তাকে পশ্চিম দিক হ’তে উদিত করুন’। ﻓَﺒُﻬِﺖَ ﺍﻟَّﺬِﻱْ ﻛَﻔَﺮَ ‘অতঃপর কাফের (নমরূদ) এতে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮)।
কওমের নেতারাই যেখানে পরাজয়কে মেনে নেয়নি, সেখানে দেশের একচ্ছত্র সম্রাট কেন পরাজয়কে মেনে  নিবেন। যথারীতি তিনিও অহংকারে ফেটে পড়লেন এবং ইবরাহীমকে জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নির্দেশ জারি করলেন। সাথে সাথে জনগণকে ধর্মের দোহাই দিয়ে বললেন, ﺣَﺮِّﻗُﻮﻩُ ﻭَﺍﻧﺼُﺮُﻭﺍ ﺁﻟِﻬَﺘَﻜُﻢْ ﺇِﻥْ ﻛُﻨﺘُﻢْ ﻓَﺎﻋِﻠِﻴْﻦَ ‘তোমরা একে পুড়িয়ে মার এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৮)। উল্লেখ্য যে, কুরআন কোথাও নমরূদের নাম উল্লেখ করেনি এবং সে যে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ উপাস্য’ দাবী করেছিল, এমন কথাও স্পষ্টভাবে বলেনি। তবে ‘আমিও বাঁচাতে পারি ও মারতে পারি’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮) তার এই কথার মধ্যে তার সর্বোচ্চ অহংকারী হবার এবং ইবরাহীমের ‘রব’-এর বিপরীতে নিজেকে এভাবে উপস্থাপন করায় সে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ রব’ হিসাবে ধারণা করেছিল বলে প্রতীয়মান হয়। প্রধানত: ইস্রাঈলী বর্ণনাসমূহের উপরে ভিত্তি করেই ‘নমরূদ’-এর নাম ও তার রাজত্ব সম্পর্কে জানা যায়। কুরআন কেবল অতটুকুই বলেছে, যতটুকু মানব জাতির হেদায়াতের জন্য প্রয়োজন।
যুক্তিতর্কে হেরে গিয়ে নমরূদ ইবরাহীম (আঃ)-কে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার হুকুম দিল। অতঃপর তার জন্য বিরাটাকারের আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন, ﻭَﺃَﺭَﺍﺩُﻭْﺍ ﺑِﻪِ ﻛَﻴْﺪﺍً ﻓَﺠَﻌَﻠْﻨَﺎﻫُﻢُ ﺍﻟْﺄَﺧْﺴَﺮِﻳْﻦَ ، ‘তারা ইবরাহীমের বিরুদ্ধে মহা ফন্দি অাঁটতে চাইল। অতঃপর আমরা তাদেরকেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম’
(আম্বিয়া ২১/৭০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ﻓَﺠَﻌَﻠْﻨَﺎﻫُﻢُ ﺍﻟْﺄَﺳْﻔَﻠِﻴﻦَ ، ‘আমরা তাদেরকে পরাভূত করে দিলাম’ (ছাফফাত ৩৭/৯৮)।
অতঃপর ‘একটা ভিত নির্মাণ করা হ’ল এবং সেখানে বিরাট অগ্নিকুন্ড তৈরী করা হ’ল। তারপর সেখানে তাকে নিক্ষেপ করা হ’ল’ (ছাফফাত ৩৭/৯৭)। ছহীহ বুখারীতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপের সময় ইবরাহীম (আঃ) বলে ওঠেন, ﺣَﺴْﺒُﻨَﺎ ﺍﻟﻠﻪُ ﻭَﻧِﻌْﻢَ ﺍﻟْﻮَﻛِﻴﻞُ ، ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’।
[9]
একই প্রার্থনা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) করেছিলেন, ওহোদ যুদ্ধে আহত মুজাহিদগণ যখন শুনতে পান যে, আবু সুফিয়ান মক্কায় ফিরে না গিয়ে পুনরায় ফিরে আসছে মদীনায় মুসলিম শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, তখন ‘হামরাউল আসাদে’ উপনীত তার পশ্চাদ্ধাবনকারী ৭০ জন আহত ছাহাবীর ক্ষুদ্র দল রাসূলের সাথে সমস্বরে বলে উঠেছিল ﺣَﺴْﺒُﻨَﺎ ﺍﻟﻠّﻪُ ﻭَﻧِﻌْﻢَ ﺍﻟْﻮَﻛِﻴْﻞُ ، ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’ ঘটনাটি কুরআনেও বর্ণিত হয়েছে’।[10] এভাবে পিতা ইবরাহীম ও পুত্র মুহাম্মাদের বিপদ মুহূর্তের বক্তব্যে শব্দে শব্দে মিল হয়ে যায়। তবে সার্বিক প্রচেষ্টার সাথেই কেবল উক্ত দো‘আ পাঠ করতে হবে। নইলে কেবল দো‘আ পড়ে নিষ্ক্রিয় বসে থাকলে চলবে না। যেমন ইবরাহীম (আঃ) সর্বোচ্চ পর্যায়ে দাওয়াত দিয়ে চূড়ান্ত বিপদের সময় এ দো‘আ করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিরোধী পক্ষের সেনাপতি আবু সুফিয়ানের পশ্চাদ্ধাবনের পরেই উক্ত দো‘আ পড়েছিলেন।
বস্ত্ততঃ এই কঠিন মুহূর্তের পরীক্ষায় জয়লাভ করার পুরস্কার স্বরূপ সাথে সাথে আল্লাহর নির্দেশ এল ﻗُﻠْﻨَﺎ ﻳَﺎ ﻧَﺎﺭُ ﻛُﻮﻧِﻲْ ﺑَﺮْﺩﺍً ﻭَّﺳَﻼَﻣﺎً ﻋَﻠَﻰ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴﻢَ ، ‘হে আগুন! ঠান্ডা হয়ে যাও এবং ইবরাহীমের উপরে শান্তিদায়ক হয়ে যাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৯)। অতঃপর ইবরাহীম মুক্তি পেলেন।
অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইবরাহীম (আঃ) ফিরে আসেন এবং এভাবে আল্লাহ কাফিরদের সমস্ত কৌশল বরবাদ করে দেন। এরপর শুরু হ’ল জীবনের আরেক অধ্যায়।

হিজরতের পালা :

ইসলামী আন্দোলনে দাওয়াত ও হিজরত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তৎকালীন পৃথিবীর সমৃদ্ধতম নগরী ছিল বাবেল, যা বর্তমানে ‘বাগদাদ’ নামে পরিচিত।
[11] তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে এবং মূর্তিপূজারী ও তারকাপূজারী নেতাদের সাথে তর্কযুদ্ধে জয়ী হয়ে অবশেষে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে ইবরাহীমের দাওয়াত ও তার প্রভাব সকলের নিকটে পৌঁছে গিয়েছিল। যদিও সমাজপতি ও শাসকদের অত্যাচারের ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ ইসলাম কবুলের ঘোষণা দেয়নি। কিন্তু তাওহীদের দাওয়াত তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল এবং তা সাধারণ জনগণের হৃদয়ে আসন গেড়ে নিয়েছিল।
অতএব এবার অন্যত্র দাওয়াতের পালা। ইবরাহীম (আঃ) সত্তরোর্ধ্ব বয়সে অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হন। এই দীর্ঘ দিন দাওয়াত দেওয়ার পরেও নিজের স্ত্রী সারাহ ও ভাতিজা লূত ব্যতীত কেউ প্রকাশ্যে ঈমান আনেনি। ফলে পিতা ও সম্প্রদায় কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি আল্লাহর হুকুমে হিজরতের সিদ্ধান্ত নেন। যাওয়ার পূর্বে তিনি নিজ সম্প্রদায়কে ডেকে যে বিদায়ী ভাষণ দেন, তার মধ্যে সকল যুগের তাওহীদবাদী গণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় লুকিয়ে রয়েছে।

ইবরাহীমের হিজরত-পূর্ব বিদায়ী ভাষণ:

আল্লাহর ভাষায়,

ﻗَﺪْ ﻛَﺎﻧَﺖْ ﻟَﻜُﻢْ ﺃُﺳْﻮَﺓٌ ﺣَﺴَﻨَﺔٌ ﻓِﻲ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴﻢَ ﻭَﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻣَﻌَﻪُ ﺇِﺫْ ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻟِﻘَﻮْﻣِﻬِﻢْ ﺇِﻧَّﺎ ﺑُﺮَﺁﺅُﺍ ﻣِﻨﻜُﻢْ ﻭَﻣِﻤَّﺎ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭْﻥَ ﻣِﻦْ ﺩُﻭْﻥِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻛَﻔَﺮْﻧَﺎ ﺑِﻜُﻢْ ﻭَﺑَﺪَﺍ ﺑَﻴْﻨَﻨَﺎ ﻭَﺑَﻴْﻨَﻜُﻢُ ﺍﻟْﻌَﺪَﺍﻭَﺓُ ﻭَﺍﻟْﺒَﻐْﻀَﺎﺀُ ﺃَﺑَﺪﺍً ﺣَﺘَّﻰ ﺗُﺆْﻣِﻨُﻮْﺍ ﺑِﺎﻟﻠﻪِ ﻭَﺣْﺪَﻩُ ﺇِﻻَّ ﻗَﻮْﻝَ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ ﻟِﺄَﺑِﻴْﻪِ ﻟَﺄَﺳْﺘَﻐْﻔِﺮَﻥَّ ﻟَﻚَ ﻭَﻣَﺎ ﺃَﻣْﻠِﻚُ ﻟَﻚَ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻣِﻦْ ﺷَﻲْﺀٍ، ﺭَﺑَّﻨَﺎ ﻋَﻠَﻴْﻚَ ﺗَﻮَﻛَّﻠْﻨَﺎ ﻭَﺇِﻟَﻴْﻚَ ﺃَﻧَﺒْﻨَﺎ ﻭَﺇِﻟَﻴْﻚَ ﺍﻟْﻤَﺼِﻴﺮُ-
‘তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, আমরা সম্পর্ক ছিন্ন করছি তোমাদের সাথে এবং তাদের সাথে যাদেরকে তোমরা পূজা কর আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে। আমরা তোমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করছি এবং আমাদের ও তোমাদের মাঝে স্থায়ী  শত্রুতা ও বিদ্বেষ বিঘোষিত হ’ল যতদিন না তোমরা কেবলমাত্র এক আল্লাহর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করবে। … প্রভু হে! আমরা কেবল তোমার উপরেই ভরসা করছি এবং তোমার দিকেই মুখ ফিরাচ্ছি ও তোমার নিকটেই আমাদের প্রত্যাবর্তন স্থল’ (মুমতাহানাহ ৬০/৪)। এরপর তিনি কওমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ﺇِﻧِّﻲ ﺫَﺍﻫِﺐٌ ﺇِﻟَﻰ ﺭَﺑِّﻲ ﺳَﻴَﻬْﺪِﻳْﻦِ ، ‘আমি চললাম আমার প্রভুর পানে, সত্বর তিনি আমাকে পথ দেখাবেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৯)। অতঃপর তিনি চললেন দিশাহীন যাত্রাপথে।
আল্লাহ বলেন, ﻭَﻧَﺠَّﻴْﻨَﺎﻩُ ﻭَﻟُﻮﻃﺎً ﺇِﻟَﻰ ﺍﻟْﺄَﺭْﺽِ ﺍﻟَّﺘِﻲ ﺑَﺎﺭَﻛْﻨَﺎ ﻓِﻴﻬَﺎ ﻟِﻠْﻌَﺎﻟَﻤِﻴْﻦَ ، ‘আর আমরা তাকে ও লূতকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম সেই দেশে, যেখানে বিশ্বের জন্য কল্যাণ রেখেছি’ (আম্বিয়া ২১/৭১)। এখানে তাঁর সাথী বিবি সারা-র কথা বলা হয়নি নারীর গোপনীয়তা রক্ষার শিষ্টাচারের প্রতি খেয়াল করে। আধুনিক নারীবাদীদের জন্য এর মধ্যে শিক্ষণীয়  বিষয় রয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রী সারা ও ভাতিজা লূতকে পথ প্রদর্শন করে নিয়ে গেলেন পার্শ্ববর্তী দেশ শাম বা সিরিয়ার অন্তর্গত বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অদূরে কেন‘আন নামক স্থানে, যা এখন তাঁর নামানুসারে ‘খালীল’ (ﺍﻟﺨﻠﻴﻞ ) নামে পরিচিত হয়েছে। ঐ সময় সেখানে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অস্তিত্ব ছিল না। এখানেই ইবরাহীম (আঃ) বাকী জীবন অতিবাহিত করেন ও এখানেই কবরস্থ হন। এখানে হিজরতের সময় তাঁর বয়স ৮০ থেকে ৮৫-এর মধ্যে ছিল এবং বিবি সারা-র ৭০ থেকে ৭৫-এর মধ্যে। সঙ্গী ভাতিজা লূতকে আল্লাহ নবুঅত দান করেন ও তাকে পার্শ্ববর্তী সমৃদ্ধ নগরী সাদূমসহ পাঁচটি নগরীর লোকদের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয় ও তিনি সেখানেই বসবাস করেন। ফলে ইবরাহীমের জীবনে নিঃসঙ্গতার এক কষ্টকর অধ্যায় শুরু হয়।
উল্লেখ্য যে, মানবজাতির প্রথম ফসল ডুমুর (তীন) বর্তমান ফিলিস্তীনেই উৎপন্ন হয়েছিল আজ থেকে এগারো হাযার বছর আগে। সম্প্রতি সেখানে প্রাপ্ত শুকনো ডুমুর পরীক্ষা করে এ তথ্য জানা গেছে।[12]

কেন‘আনের জীবন :

জন্মভূমি বাবেল শহরে জীবনের প্রথমাংশ অতিবাহিত করার পর হিজরত ভূমি শামের কেন‘আনে তিনি জীবনের বাকী অংশ কাটাতে শুরু করেন। তাঁর জীবনের অন্যান্য পরীক্ষা সমূহ এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। কিছু দিন অতিবাহিত করার পর এখানে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। মানুষ সব দলে দলে ছুটতে থাকে মিসরের দিকে। মিসর তখন ফেরাঊনদের শাসনাধীনে ছিল। উল্লেখ্য যে, মিসরের শাসকদের উপাধি ছিল ‘ফেরাঊন’। ইবরাহীম ও মূসার সময় মিসর ফেরাঊনদের শাসনাধীনে ছিল। মাঝখানে ইউসুফ-এর সময়ে ২০০ বছরের জন্য মিসর হাকসূস (ﺍﻟﻬﻜﺴﻮﺱ ) রাজাদের অধীনস্থ ছিল। যা ছিল ঈসা (আঃ)-এর আবির্ভাবের প্রায় ২০০০ বছর আগেকার ঘটনা’।[13]

মিসর সফর :

দুর্ভিক্ষ তাড়িত কেন‘আন হ’তে অন্যান্যদের ন্যায় ইবরাহীম (আঃ) সস্ত্রীক মিসরে রওয়ানা হ’লেন। ইচ্ছা করলে আল্লাহ তাঁর জন্য এখানেই রূযী পাঠাতে পারতেন। কিন্তু না। তিনি মিসরে কষ্টকর সফরে রওয়ানা হ’লেন। সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল এক কঠিন ও মর্মান্তিক পরীক্ষা এবং সাথে সাথে একটি নগদ ও অমূল্য পুরষ্কার।
ঐ সময় মিসরের ফেরাঊন ছিল একজন নারী লোলুপ মদ্যপ শাসক। তার নিয়োজিত লোকেরা রাস্তার পথিকদের মধ্যে কোন সুন্দরী মহিলা পেলেই তাকে ধরে নিয়ে বাদশাহকে পৌঁছে দিত। যদিও বিবি ‘সারা’ ঐ সময় ছিলেন বৃদ্ধা মহিলা, তথাপি তিনি ছিলেন সৌন্দর্য্যের রাণী। মিসরীয় সম্রাটের নিয়ম ছিল এই যে, যে মহিলাকে তারা অপহরণ করত, তার সাথী পুরুষ লোকটি যদি স্বামী হ’ত, তাহ’লে তাকে হত্যা করে মহিলাকে নিয়ে যেত। আর যদি ভাই বা পিতা হ’ত, তাহ’লে তাকে ছেড়ে দিত। তারা ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করলে তিনি সারাকে তাঁর ‘বোন’ পরিচয় দিলেন। নিঃসন্দেহে ‘সারা’ তার ইসলামী বোন ছিলেন। ইবরাহীম তাকে আল্লাহর যিম্মায় ছেড়ে দিয়ে ছালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন ও আল্লাহর নিকটে স্বীয় স্ত্রীর ইয্যতের হেফাযতের জন্য আকুলভাবে প্রার্থনা করতে থাকলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ নিশ্চয়ই তার স্ত্রীর ইয্যতের হেফাযত করবেন।
সারাকে যথারীতি ফেরাঊনের কাছে আনা হ’ল। অতঃপর পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
ﻓﻠﻤَّﺎ ﺩَﺧﻠﺖْ ﺳﺎﺭﺓُ ﻋﻠﻰ ﺍﻟْﻤَﻠِﻚِ ﻗﺎﻡَ ﺇﻟﻴﻬﺎ ﻓﺄَﻗﺒﻠﺖْ ﺗﺘﻮﺿﺄُ ﻭ ﺗُﺼَﻠﻰِّ ﻭﺗﻘﻮﻝُ : ﺃﻟﻠَّﻬﻢ ﺇِﻥْ ﻛﻨﺖَ ﺗﻌﻠﻢُ ﺃَﻧِّﻲ ﺁﻣﻨﺖُ ﺑِﻚَ ﻭﺑﺮﺳﻮﻟﻚَ ﻭﺃَﺣْﺼﻨﺖُ ﻓَﺮْﺟِﻲ ﺇﻻ ﻋﻠﻰ ﺯﻭﺟﻲ ﻓﻼ ﺗُﺴﻠِّﻂْ ﻋﻠﻰَّ ﺍﻟﻜﺎﻓﺮَ ু ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺒﺨﺎﺭﻯُّ ﻭ ﺃﺣﻤﺪ ﺑﺈِﺳﻨﺎﺩٍ ﺻﺤﻴﺢٍ –
‘যখন সারা সম্রাটের নিকটে নীত হ’লেন এবং সম্রাট তার দিকে এগিয়ে এল, তখন তিনি ওযূ করার জন্য গেলেন ও ছালাতে রত হয়ে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! যদি তুমি জেনে থাক যে, আমি তোমার উপরে ও তোমার রাসূলের উপরে ঈমান এনেছি এবং আমি আমার একমাত্র স্বামীর জন্য সতীত্ব বজায় রেখেছি, তাহ’লে তুমি আমার উপরে এই কাফিরকে বিজয়ী করো না’। [14]
সতীসাধ্বী স্ত্রী সারার দো‘আ সঙ্গে সঙ্গে কবুল হয়ে গেল। সম্রাট এগিয়ে আসার উপক্রম করতেই হাত-পা অবশ হয়ে পড়ে গিয়ে গোঙাতে লাগলো। তখন সারাহ প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! লোকটি যদি এভাবে মারা যায়, তাহ’লে লোকেরা ভাববে আমি ওকে হত্যা করেছি’। তখন আল্লাহ সম্রাটকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু শয়তান আবার এগিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে আবার মরার মত পড়ে রইল।
এভাবে সে দুই অথবা তিনবার বেহুঁশ হয়ে পড়লো আর সারা-র দো‘আয় বাঁচলো। অবশেষে সে বলল, তোমরা আমার কাছে একটা শয়তানীকে পাঠিয়েছ। যাও একে ইবরাহীমের কাছে ফেরত দিয়ে আসো এবং এর খেদমতের জন্য হাজেরাকে দিয়ে দাও। অতঃপর সারাহ তার খাদেমা হাজেরাকে নিয়ে সসম্মানে স্বামী ইবরাহীমের কাছে ফিরে এলেন’(ঐ)। এই সময় ইবরাহীম ছালাতের মধ্যে সারার জন্য প্রার্থনায় রত ছিলেন। সারা ফিরে এলে তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। আল-হামদুলিল্লাহ! যে আল্লাহ তাঁর বান্দা ইবরাহীমকে নমরূদের প্রজ্জ্বলিত হুতাশন থেকে বাঁচিয়ে এনেছেন, সেই আল্লাহ ইবরাহীমের ঈমানদার স্ত্রীকে ফেরাঊনের লালসার আগুন থেকে কেন বাঁচিয়ে আনবেন না? অতএব সর্বাবস্থায় যাবতীয় প্রশংসা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য।
‘আবুল আম্বিয়া’ ( ﺃﺑﻮ ﺍﻷﻧﺒﻴﺎﺀ ) হিসাবে আল্লাহ পাক যেভাবে ইবরাহীমের পরীক্ষা নিয়েছেন, উম্মুল আম্বিয়া ( ﺃﻡ ﺍﻷﻧﺒﻴﺎﺀ ) হিসাবে তিনি তেমনি বিবি সারা-র পরীক্ষা নিলেন এবং উভয়ে পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হ’লেন।
ফালিল্লাহিল হাম্দ।
ধারণা করা চলে যে, ফেরাঊন কেবল হাজেরাকেই উপহার স্বরূপ দেয়নি। বরং অন্যান্য রাজকীয় উপঢৌকনাদিও দিয়েছিল। যাতে ইবরাহীমের মিসর গমনের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যায় এবং বিপুল মাল-সামান ও উপঢৌকনাদি সহ তিনি কেন‘আনে ফিরে আসেন।

শিক্ষণীয় বিষয় :

উপরোক্ত ঘটনার মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, বান্দা যখন নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে সোপর্দ করে দেয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই সকল কাজ করে, তখন আল্লাহ তার পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে নেন। তার জান-মাল-ইয্যত সবকিছু তিনিই হেফাযত করেন। আলোচ্য ঘটনায় ইবরাহীম ও সারাহ ছিলেন একেবারেই অসহায়। তারা স্রেফ আল্লাহর উপরেই নির্ভর করেছেন, তাঁর কাছেই কেঁদেছেন, তাঁর কাছেই চেয়েছেন। ফলে আল্লাহ তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন।
দ্বিতীয় শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, বান্দার দায়িত্ব হ’ল, যেকোন মূল্যে হক-এর উপরে দৃঢ় থাকা ও অন্যকে হক-এর পথে দাওয়াত দেওয়া। ইবরাহীম দারিদ্রে্যর তাড়নায় কাফেরের দেশ মিসরে গিয়েছিলেন। কিন্তু নিজেরা যেমন ‘হক’ থেকে বিচ্যুত হননি, তেমনি অন্যকে দাওয়াত দিতেও পিছপা হননি। ফলে আল্লাহ তাঁকে মর্মান্তিক বিপদের মধ্যে ফেলে মহা পুরষ্কারে ভূষিত করলেন।

ইবরাহীমের কথিত তিনটি মিথ্যার ব্যাখ্যা :

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন যে, ﻟﻢ ﻳَﻜْﺬِﺏْ ﺇﺑﺮﺍﻫﻴﻢُ ﻋﻠﻴﻪ ﺍﻟﺼﻼﺓُ ﻭﺍﻟﺴﻼﻡ ﺇﻻّ ﺛﻼﺙَ ﻛَﺬَﺑﺎﺕٍ، ‘ইবরাহীম (আঃ) তিনটি ব্যতীত কোন মিথ্যা বলেননি’। উক্ত তিনটি মিথ্যা ছিল-

(১) মেলায় না যাবার অজুহাত হিসাবে তিনি বলেছিলেন ﺇِﻧِّﻲْ ﺳَﻘِﻴْﻢٌ ‘আমি অসুস্থ’ (ছাফফাত ৩৭/৮৯)।

(২) মূর্তি ভেঙ্গেছে কে? এরূপ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ﺑَﻞْ ﻓَﻌَﻠَﻪُ ﻛَﺒِﻴﺮُﻫُﻢْ ﻫَﺬَﺍ ‘বরং এই বড় মূর্তিটাই এ কাজ করেছে’
(আম্বিয়া ২১/৬৩)।

(৩) মিসরের লম্পট রাজার হাত থেকে বাঁচার জন্য স্ত্রী সারা-কে তিনি বোন হিসাবে পরিচয় দেন।[15]
হাদীছে উক্ত তিনটি বিষয়কে ‘মিথ্যা’ শব্দে উল্লেখ করা হ’লেও মূলতঃ এগুলির একটাও প্রকৃত অর্থে মিথ্যা ছিল না। বরং এগুলি ছিল আরবী অলংকার শাস্ত্রের পরিভাষায় ‘তাওরিয়া’ (ﺍﻟﺔﻭﺭﻳﺔ) বা দ্ব্যর্থ বোধক পরিভাষা। যেখানে শ্রোতা বুঝে এক অর্থ এবং বক্তার নিয়তে থাকে অন্য অর্থ। যেমন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন হযরত আয়েশার কাছে তার এক বৃদ্ধা খালাকে দেখে বললেন, কোন বৃদ্ধা জান্নাতে যাবে না। একথা শুনে খালা কান্না শুরু করলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তারা তখন সবাই যুবতী হয়ে যাবে’।[16] হিজরতের সময় পথিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সম্পর্কে জনৈক ব্যক্তির প্রশ্নের জওয়াবে আবুবকর (রাঃ) বলেন, ﻫﺬﺍ ﺍﻟﺮﺟﻞُ ﻳَﻬْﺪﻳﻨﻲ ﺍﻟﻄﺮﻳﻖَ ‘ইনি আমাকে পথ দেখিয়ে থাকেন’।[17] এতে লোকটি ভাবল, উনি একজন সাধারণ পথপ্রদর্শক ব্যক্তি মাত্র। অথচ আবুবকরের উদ্দেশ্য ছিল তিনি আমাদের নবী অর্থাৎ ধর্মীয় পথপ্রদর্শক ( ﻳﻬﺪﻳﻨﻲ ﺍﻟﻰ ﻃﺮﻳﻖ ﺍﻟﺠﻨﺔ )। অনুরূপভাবে যুদ্ধকালে রাসূল (ছাঃ) একদিকে বেরিয়ে অন্য দিকে চলে যেতেন। যাতে তাঁর গন্তব্য পথ গোপন থাকে। এগুলি হ’ল উক্তিগত ও কর্মগত তাওরিয়ার উদাহরণ।

তাওরিয়া ও তাক্বিয়াহঃ

উল্লেখ্য যে, এই তাওরিয়া ও শী‘আদের তাক্বিয়াহর (ﺓﻗﻴﺔ) মধ্যে পার্থক্য এই যে, সেখানে পুরাটাই মিথ্যা বলা হয় ও সেভাবেই কাজ করা হয়। যেমন উদাহরণ স্বরূপ,

(১) শী‘আদের ৬ষ্ঠ ইমাম আবু আব্দুল্লাহ জাফর, যিনি আছ-ছাদিক্ব বা সত্যবাদী বলে উপাধিপ্রাপ্ত, একদিন তাঁর নিকটতম শিষ্য মুহাম্মাদ বিন মুসলিম তাঁর নিকটে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার জন্য আমার জীবন উৎসর্গীত হৌক! গতরাতে আমি একটি অদ্ভূত স্বপ্ন দেখেছি। তখন তিনি বললেন, তোমার স্বপ্ন বৃত্তান্ত বর্ণনা কর। এখানে একজন স্বপ্ন বিশেষজ্ঞ মওজূদ আছেন। বলে তিনি সেখানে উপবিষ্ট অন্যতম শিষ্য ইমাম আবু হানীফার দিকে ইঙ্গিত করলেন। অতঃপর শিষ্য মুহাম্মাদ বিন মুসলিম তার স্বপ্ন বর্ণনা করলেন এবং আবু হানীফা তার ব্যাখ্যা দিলেন। ব্যাখ্যা শুনে ইমাম জাফর ছাদেক খুশী হয়ে বললেন, আল্লাহর কসম! আপনি সঠিক বলেছেন হে আবু হানীফা। রাবী বলেন, অতঃপর আবু হানীফা সেখান থেকে চলে গেলে আমি ইমামকে বললাম, আপনার প্রতি আমার জীবন উৎসর্গীত হৌক! এই বিধর্মীর (নাছেবী) স্বপ্ন ব্যাখ্যা আমার মোটেই পসন্দ হয়নি। তখন ইমাম বললেন, হে ইবনু মুসলিম! এতে তুমি মন খারাব করো না। এদের ব্যাখ্যা আমাদের ব্যাখ্যা থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। আবু হানীফা যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা সঠিক নয়। আমি বললাম, তাহ’লে আমি আল্লাহর কসম করে তার ব্যাখ্যাকে সঠিক বললেন কেন? ইমাম বললেন, ﻧﻌﻢ ﺣﻠﻔﺖ ﻋﻠﻴﻪ ﺍﻧﻪ ﺍﺻﺎﺏ ﺍﻟﺨﻄﺄ হ্যাঁ, আমি কসম করে এটাই বলেছি যে, উনি যথাযর্থভাবেই ভুল বলেছেন।’
অথচ এই মিথ্যা বলার জন্য সেখানে কোন ভয়-ভীতির কারণ ছিল না। কেননা উভয়ে ইমামের শিষ্য ছিলেন। উপরন্তু আবু হানীফা তখন সরকারের অপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন।’[18] এটাই হ’ল শী‘আদের তাক্বিয়া নীতি, যা স্রেফ মিথ্যা ব্যতীত কিছুই নয় এবং যার মাধ্যমে তারা মানুষকে ধোঁকা দিয়ে থাকে ও প্রতারণা করে থাকে। এই মিথ্যাচারকে ইমাম জাফর ছাদেক তাদের দ্বীনের ১০ ভাগের নয় ভাগ মনে করেন। তিনি বলেন, ঐ ব্যক্তির দ্বীন নেই, যার তাক্বিয়া নেই (ঐ, পৃঃ ১৫৩)।

(২) ব্যাকরণবিদ হুসায়েন বিন মু‘আয বিন মুসলিম বলেন, আমাকে একদিন ইমাম জাফর ছাদিক বললেন, শুনছি তুমি নাকি জুম‘আ মসজিদে বসছ এবং লোকদের ফৎওয়া দিচ্ছ? আমি বললাম, হাঁ। তবে আপনার কাছ থেকে বের হবার আগেই আমি আপনাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম যে, আমি জুম‘আ মসজিদে বসি, তারপর লোকেরা এসে আমাকে প্রশ্ন করে। আমি যখন বুঝি যে, লোকটি আমার ইচ্ছার বিরোধী, তখন আমি তাকে তার চাহিদা অনুযায়ী ফৎওয়া দেই।’ একথা শোনার পর ইমাম জাফর ছাদিক আমাকে বললেন, ﺍﺻﻨﻊ ﻛﺬﺍ ﻓﺎﻧﻰ ﺍﺻﻨﻊ ﻛﺬﺍ ‘তুমি এভাবেই করো। কেননা আমিও এভাবে করে থাকি’ (ঐ, পৃঃ ১৭১-৭২)। অথচ সত্য কখনোই মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত হয় না এবং সত্য সংখ্যক সর্বদা একটিই হয়, তা কখনোই বহু হয় না। আল্লাহ বলেন, যদি সত্য তাদের প্রবৃত্তির অনুগামী হ’ত, তাহ’লে আকাশ ও পৃথিবী এবং এর মধ্যস্থিত সবকিছু ধ্বংস হয়ে যেত’ (মুমিনূন ২৩/৭১)। বস্ত্তত: এই তাক্বিয়া নীতি শী‘আদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অঙ্গীভূত। যা ইসলামের মৌল নীতির ঘোর বিরোধী। কিন্তু তাওরিয়ায় বক্তা যে অর্থে উক্ত কথা বলেন তা সম্পূর্ণ সত্য হয়ে থাকে। যেমন- (১) ইবরাহীম নিজেকে ﺳﻘﻴﻢ (অসুস্থ) বলেছিলেন, কিন্তু ﻣﺮﻳﺾ (পীড়িত) বলেননি। নিজ সম্প্রদায়ের শিরকী কর্মকান্ডে এমনিতেই তিনি ত্যক্ত-বিরক্ত ও বিতৃষ্ণ ছিলেন। তদুপরি শিরকী মেলায় যাওয়ার আবেদন পেয়ে তাঁর পক্ষে মানসিকভাবে অসুস্থ ( ﺳﻘﻴﻢ ﻣﻦ ﻋﻤﻠﻬﻢ) হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এরপরেও তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকতেও পারেন। (২) সব মূর্তি ভেঙ্গে তিনি বড় মূর্তিটার গলায় বা হাতে কুড়াল ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। যাতে প্রমাণিত হয় যে, সেই-ই একাজ করেছে। এর দ্বারা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কওমের মূর্খতাকে হাতে নাতে ধরিয়ে দেওয়া এবং তাদের মূর্তিপূজার অসারতা চোখে  আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। তাই মূর্তি ভাঙ্গার কাজটি তিনি বড় মূর্তির দিকে সম্বন্ধ করেন রূপকভাবে। তাছাড়া ঐ বড় মূর্তিটির প্রতিই লোকেদের ভক্তি ও বিশ্বাস ছিল সর্বাধিক। এর কারণেই মানুষ পথভ্রষ্ট হয়েছিল বেশী। ফলে সেই-ই মূলতঃ ইবরাহীমকে মূর্তি ভাঙ্গায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। অতএব একদিক দিয়ে সেই-ই ছিল মূল দায়ী।
(৩) সারা-কে বোন বলা। নিঃসন্দেহে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরে দ্বীনী ভাই-বোন। স্ত্রীর ইযযত ও নিজের জীবন রক্ষার্থে এটুকু বলা মোটেই মিথ্যার মধ্যে পড়ে না।
এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল, তবুও হাদীছে একে ‘মিথ্যা’ বলে অভিহিত করা হ’ল কেন? এর জবাব এই যে, নবী-রাসূলগণের সামান্যতম ত্রুটিকেও আল্লাহ বড় করে দেখেন তাদেরকে সাবধান করার জন্য। যেমন ভুলক্রমে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়াকে আল্লাহ আদমের ‘অবাধ্যতা ও পথভ্রষ্টতা’ ( ﻭَﻋَﺼَﻰ ﺁﺩَﻡُ ﺭَﺑَّﻪُ ﻓَﻐَﻮَﻯ ( ] 19 ] বলে অভিহিত করেছেন। অথচ ভুলক্রমে কৃত অপরাধ ক্ষমার যোগ্য। উল্লেখ্য যে, মাওলানা মওদূদীর ন্যায় কোন কোন মুফাসসির এখানে হাদীছের রাবী আবু হুরায়রাকেই উক্ত বর্ণনার জন্য দায়ী করেছেন, যা নিতান্ত অন্যায়।

কেন‘আনে প্রত্যাবর্তন :

ইবরাহীম (আঃ) যথারীতি মিসর থেকে কেন‘আনে ফিরে এলেন। বন্ধ্যা স্ত্রী সারা তার খাদেমা হাজেরাকে প্রাণপ্রিয় স্বামী ইবরাহীমকে উৎসর্গ করলেন। ইবরাহীম তাকে স্ত্রীত্বে বরণ করে নিলেন। পরে দ্বিতীয়া স্ত্রী হাজেরার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন তার প্রথম সন্তান ইসমাঈল (আঃ)। এই সময় ইবরাহীমের বয়স ছিল অন্যূন ৮৬ বছর। নিঃসন্তান পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। শুষ্ক মরুতে যেন প্রাণের জোয়ার এলো। বস্ত্তত: ইসমাঈল ছিলেন নিঃসন্তান ইবরাহীমের দো‘আর ফসল। কেননা তিনি বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহর নিকটে ‘নেককার সন্তান’ কামনা করেছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ﺭَﺏِّ ﻫَﺐْ ﻟِﻲ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴْﻦَ، ﻓَﺒَﺸَّﺮْﻧَﺎﻩُ ﺑِﻐُﻼَﻡٍ ﺣَﻠِﻴْﻢٍ – ‘(ইবরাহীম বললেন,) হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি সৎকর্মশীল সন্তান দাও। অতঃপর আমরা তাকে একটি ধৈর্য্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।’ (ছাফফাত ৩৭/১০০-১০১)।

ইবরাহীমী জীবনের পরীক্ষা সমূহ :

ইবরাহীমী জীবন মানেই পরীক্ষার জীবন। নবী হবার পর থেকে আমৃত্যু তিনি পরীক্ষা দিয়েই জীবনপাত করেছেন। এভাবে পরীক্ষার পর পরীক্ষা নিয়ে তাঁকে পূর্ণত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। অবশেষে তাঁকে ‘বিশ্বনেতা’ ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
ﻭَﺇِﺫِ ﺍﺑْﺘَﻠَﻰ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴﻢَ ﺭَﺑُّﻪُ ﺑِﻜَﻠِﻤَﺎﺕٍ ﻓَﺄَﺗَﻤَّﻬُﻦَّ ﻗَﺎﻝَ ﺇِﻧِّﻲ ﺟَﺎﻋِﻠُﻚَ ﻟِﻠﻨَّﺎﺱِ ﺇِﻣَﺎﻣﺎً ﻗَﺎﻝَ ﻭَﻣِﻦْ ﺫُﺭِّﻳَّﺘِﻲْ ﻗَﺎﻝَ ﻻَ ﻳَﻨَﺎﻝُ ﻋَﻬْﺪِﻱ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻤِﻴﻦَ
‘যখন ইবরাহীমকে তার পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তাতে উত্তীর্ণ হ’লেন, তখন আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করব। তিনি বললেন, আমার বংশধর থেকেও। তিনি বললেন, আমার অঙ্গীকার যালেমদের পর্যন্ত পৌঁছবে না’ (বাক্বারাহ ২/১২৪)। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ইবরাহীম ও তাঁর বংশধরগণের মধ্যেই বিশ্ব নেতৃত্ব সীমিত রেখেছেন। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠّﻪَ ﺍﺻْﻄَﻔَﻰ ﺁﺩَﻡَ ﻭَﻧُﻮﺣﺎً ﻭَﺁﻝَ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴﻢَ ﻭَﺁﻝَ ﻋِﻤْﺮَﺍﻥَ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻌَﺎﻟَﻤِﻴﻦَ – ﺫُﺭِّﻳَّﺔً ﺑَﻌْﻀُﻬَﺎ ﻣِﻦ ﺑَﻌْﺾٍ ﻭَﺍﻟﻠﻪ ُﺳَﻤِﻴﻊٌ ﻋَﻠِﻴﻢٌ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ, ইবরাহীম-এর বংশধর ও ইমরানের বংশধরকে নির্বাচিত করেছেন’। ‘যারা ছিল পরস্পরের বংশজাত। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আলে ইমরান ৩/৩৩, ৩৪)।
বস্ত্ততঃ ইবরাহীম (আঃ)-এর পরবর্তী সকল নবী তাঁর বংশধর ছিলেন। আলে ইমরান বলতে ইমরান-পুত্র মূসা ও হারূণ ও তাঁদের বংশধর দাঊদ, সুলায়মান, ঈসা প্রমুখ নবীগণকে বুঝানো হয়েছে। যাঁরা সবাই ছিলেন ইবরাহীমের পুত্র ইসহাকের বংশধর। অপরপক্ষে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছিলেন ইবরাহীমের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈলের বংশধর। সে হিসাবে আল্লাহ ঘোষিত ইবরাহীমের বিশ্বনেতৃত্ব যেমন বহাল রয়েছে, তেমনি নবীদের প্রতি অবাধ্যতা, বংশীয় অহংকার এবং যিদ ও হঠকারিতার জন্য যালেম ইহুদী-নাছারাগণ আল্লাহর অভিশাপ কুড়িয়ে বিশ্বের সর্বত্র ধিকৃত ও লাঞ্ছিত হয়েছে। এক্ষণে ‘নবীদের পিতা’ ও মিল্লাতে ইসলামিয়াহর নেতা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে কি কি বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল, আমরা সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করব।
ইবরাহীম (আঃ)-এর পরীক্ষা সমূহ ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। (এক) বাবেল জীবনের পরীক্ষা সমূহ এবং (দুই) কেন‘আন জীবনের পরীক্ষা সমূহ। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনের সঙ্গে পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর জীবনের সুন্দর একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মুহাম্মাদী জীবনের প্রথমাংশ কেটেছে মক্কায় ও শেষাংশ কেটেছে মদীনায় এবং সেখানেই তিনি পূর্ণতা লাভ করেন ও মৃত্যুবরণ করেন। ইবরাহীমী জীবনের প্রথমাংশ কেটেছে বাবেল শহরে এবং শেষাংশ কেটেছে কেন‘আনে। সেখানেই তিনি পূর্ণতা পেয়েছেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেছেন।

বাবেল জীবনের পরীক্ষা সমূহ :

ইবরাহীম (আঃ)-এর বাবেল জীবনের পরীক্ষা সমূহের মধ্যে (১) মূর্তিপূজারী নেতাদের সাথে তর্কযুদ্ধের পরীক্ষা (২) পিতার পক্ষ থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রাপ্তির পরীক্ষা (৩) স্ত্রী ও ভাতিজা ব্যতীত কেউ তাঁর দাওয়াত কবুল না করা সত্ত্বেও তীব্র সামাজিক বিরোধিতার মুখে একাকী দাওয়াত চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অটল থাকার মাধ্যমে আদর্শ নিষ্ঠার কঠিন পরীক্ষা (৪) তারকাপূজারীদের সাথে যুক্তিগর্ভ তর্কযুদ্ধের পরীক্ষা (৫) কেন্দ্রীয় দেবমন্দিরে ঢুকে মূর্তি ভাঙ্গার মত দুঃসাহসিক পরীক্ষা (৬) অবশেষে রাজদরবারে পৌঁছে সরাসরি সম্রাটের সাথে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পরীক্ষা এবং বিনিময়ে (৭) জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করার মর্মান্তিক শাস্তি হাসিমুখে বরণ করে নেবার অতুলনীয় অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়া। এছাড়াও সমাজ সংস্কারক হিসাবে জীবনের প্রতি পদে পদে যে অসংখ্য পরীক্ষার সম্মুখীন তাঁকে হর-হামেশা হ’তে হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
উপরে বর্ণিত পরীক্ষাগুলির সবটিতেই ইবরাহীম (আঃ) জয়লাভ করেছিলেন এবং সেগুলির আলোচনা আমরা ইতিপূর্বে করে এসেছি। এক্ষণে আমরা তাঁর কেন‘আনী জীবনের প্রধান পরীক্ষাসমূহ বিবৃত করব ইনশাআল্লাহ।

কেন‘আনী জীবনের পরীক্ষা সমূহ :

১ম পরীক্ষা:দুর্ভিক্ষে পতিত হয়ে মিসর গমন :

কেন‘আনী জীবনে তাঁর প্রথম পরীক্ষা হ’ল কঠিন দুর্ভিক্ষে তাড়িত হয়ে জীবিকার সন্ধানে মিসরে হিজরত করা। এ বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে।

২য় পরীক্ষা: সারাকে অপহরণ :

মিসরে গিয়ে সেখানকার লম্পট সম্রাট ফেরাঊনের কুদৃষ্টিতে পড়ে স্ত্রী সারাকে অপহরণের মর্মান্তিক পরীক্ষা। এ বিষয়ে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

৩য় পরীক্ষা: হাজেরাকে মক্কায় নির্বাসন :

মিসর থেকে ফিরে কেন‘আনে আসার বৎসরাধিককাল পরে প্রথম সন্তান ইসমাঈলের জন্ম লাভ হয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তিনি শিশু সন্তান ও তার মা হাজেরাকে মক্কার বিজন পাহাড়ী উপত্যকায় নিঃসঙ্গভাবে রেখে আসার এলাহী নির্দেশ লাভ করেন। বস্ত্ততঃ এটা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক পরীক্ষা। এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নরূপ:
হযরত ইবরাহীম (আঃ) যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে শিশু পুত্র ইসমাঈল ও তার মাকে মক্কায় নির্বাসনে রেখে আসার নির্দেশ পান, তখনই তার অন্তরে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, নিশ্চয়ই এ নির্দেশের মধ্যে আল্লাহর কোন মহতী পরিকল্পনা লুক্কায়িত আছে এবং নিশ্চয়ই তিনি ইসমাঈল ও তার মাকে ধ্বংস করবেন না।
অতঃপর এক থলে খেজুর ও এক মশক পানি সহ তাদের বিজনভূমিতে রেখে যখন ইবরাহীম (আঃ) একাকী ফিরে আসতে থাকেন, তখন বেদনা-বিস্মিত স্ত্রী হাজেরা ব্যাকুলভাবে তার পিছে পিছে আসতে লাগলেন। আর স্বামীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতে থাকেন। কিন্তু বুকে বেদনার পাষাণ বাঁধা ইবরাহীমের মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুলো না। তখন হাজেরা বললেন, আপনি কি আল্লাহর হুকুমে আমাদেরকে এভাবে ফেলে যাচ্ছেন? ইবরাহীম ইশারায় বললেন, হ্যাঁ। তখন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অটল বিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে হাজেরা বলে উঠলেন, ﺇﺫَﻥْ ﻻﻳُﻀَﻴِّﻌُﻨَﺎ ﺍﻟﻠﻪُ ‘তাহ’লে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না’। ফিরে এলেন তিনি সন্তানের কাছে। দু’একদিনের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে পানি ও খেজুর। কি হবে উপায়? খাদ্য ও পানি বিহনে বুকের দুধ শুকিয়ে গেলে কচি বাচ্চা কি খেয়ে বাঁচবে। পাগলপরা হয়ে তিনি মানুষের সন্ধানে দৌঁড়াতে থাকেন ছাফা ও মারওয়া পাহাড়ের এ মাথা আর ও মাথায়। এভাবে সপ্তমবারে তিনি দূর থেকে দেখেন যে, বাচ্চার পায়ের কাছ থেকে মাটির বুক চিরে বেরিয়ে আসছে ঝর্ণার ফল্গুধারা, জিব্রীলের পায়ের গোড়ালি বা তার পাখার আঘাতে যা সৃষ্টি হয়েছিল। ছুটে এসে বাচ্চাকে কোলে নিলেন অসীম মমতায়। স্নিগ্ধ পানি পান করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। হঠাৎ অদূরে একটি আওয়ায শুনে তিনি চমকে উঠলেন। উনি জিবরীল। বলে উঠলেন, ﻻ ﺗﺨﺎﻓﻮﺍ ﺍﻟﻀَّﻴﻌﺔَ، ﺇﻥَّ ﻫﺬﺍ ﺑﻴﺖُ ﺍﻟﻠﻪ ﻳَﺒْﻨﻰ ﻫﺬﺍ ﺍﻟﻐﻼﻡُ ﻭ ﺃﺑﻮﻩ ﻭﺇﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﻻﻳُﻀﻴﻊُ ﺃﻫﻠَﻪ – ‘আপনারা ভয় পাবেন না। এখানেই আল্লাহর ঘর। এই সন্তান ও তার পিতা এ ঘর সত্বর পুনর্নির্মান করবেন। আল্লাহ তাঁর ঘরের বাসিন্দাদের ধ্বংস করবেন না’। বলেই শব্দ মিলিয়ে গেল’।
অতঃপর শুরু হ’ল ইসমাঈলী জীবনের নব অধ্যায়। পানি দেখে পাখি আসলো। পাখি ওড়া দেখে ব্যবসায়ী কাফেলা আসলো। তারা এসে পানির মালিক হিসাবে হাজেরার নিকটে অনুমতি চাইলে তিনি এই শর্তে মনযুর করলেন যে, আপনাদের এখানে বসতি স্থাপন করতে হবে। বিনা পয়সায় এই প্রস্তাব তারা সাগ্রহে কবুল করল। এরাই হ’ল ইয়ামন থেকে আগত বনু জুরহুম গোত্র। বড় হয়ে ইসমাঈল এই গোত্রে বিয়ে করেন। এঁরাই কা‘বা গৃহের খাদেম হন এবং এদের শাখা গোত্র কুরায়েশ বংশে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটে।
ওদিকে ইবরাহীম (আঃ) যখন স্ত্রী ও সন্তানকে রেখে যান তখন হাজেরার দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এই বলে,
ﺭَّﺑَّﻨَﺎ ﺇِﻧِّﻲْ ﺃَﺳْﻜَﻨْﺖُ ﻣِﻦْ ﺫُﺭِّﻳَّﺘِﻲْ ﺑِﻮَﺍﺩٍ ﻏَﻴْﺮِ ﺫِﻱْ ﺯَﺭْﻉٍ ﻋِﻨْﺪَ ﺑَﻴْﺘِﻚَ ﺍﻟْﻤُﺤَﺮَّﻡِ ﺭَﺑَّﻨَﺎ ﻟِﻴُﻘِﻴْﻤُﻮﺍ ﺍﻟﺼَّﻼَﺓَ ﻓَﺎﺟْﻌَﻞْ ﺃَﻓْﺌِﺪَﺓً ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﺗَﻬْﻮِﻱْ ﺇِﻟَﻴْﻬِﻢْ ﻭَﺍﺭْﺯُﻗْﻬُﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﺜَّﻤَﺮَﺍﺕِ ﻟَﻌَﻠَّﻬُﻢْ ﻳَﺸْﻜُﺮُﻭْﻥَ – ) ﺍﺑﺮﺍﻫﻴﻢ ৩৭ ( –
‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমি আমার পরিবারের কিছু সদস্যকে তোমার মর্যাদামন্ডিত গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় বসবাসের জন্য রেখে যাচ্ছি। প্রভুহে! যাতে তারা ছালাত কায়েম করে। অতএব কিছু লোকের অন্তরকে তুমি এদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও এবং তাদেরকে ফল-ফলাদি দ্বারা রূযী দান কর। সম্ভবত: তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ  করবে’।[20]

৪র্থ পরীক্ষা: খাৎনা করণ :

ইবরাহীমের প্রতি আদেশ হ’ল খাৎনা করার জন্য। এসময় তাঁর বয়স ছিল অন্যূন ৮০ বছর। হুকুম পাওয়ার সাথে সাথে দেরী না করে নিজেই নিজের খাৎনার কাজ সম্পন্ন করলেন।[21] বিনা দ্বিধায় এই কঠিন ও বেদনাদায়ক কাজ সম্পন্ন করার মধ্যে আল্লাহর হুকুম দ্রুত পালন করার ও এ ব্যাপারে তাঁর কঠোর নিষ্ঠার প্রমাণ পাওয়া যায়।
খাৎনার এই প্রথা ইবরাহীমের অনুসারী সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে আজও চালু আছে। বস্ত্ততঃ খাৎনার মধ্যে যে অফুরন্ত কল্যাণ নিহিত রয়েছে, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীগণ তা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন। এর ফলে খাৎনাকারীগণ অসংখ্য অজানা রোগ-ব্যাধি হ’তে মুক্ত রয়েছেন এবং সুস্থ জীবন লাভে ধন্য হয়েছেন। এটি মুসলিম এবং অমুসলিমের মধ্যে একটি স্থায়ী পার্থক্যও বটে।

৫ম পরীক্ষা: পুত্র কুরবানী :

একমাত্র শিশু পুত্র ও তার মাকে মক্কায় রেখে এলেও ইবরাহীম (আঃ) মাঝে-মধ্যে সেখানে যেতেন ও দেখা-শুনা করতেন। এভাবে ইসমাঈল ১৩/১৪ বছর বয়সে উপনীত হ’লেন এবং পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার উপযুক্ত হ’লেন। বলা চলে যে, ইসমাঈল যখন বৃদ্ধ পিতার সহযোগী হ’তে চলেছেন এবং পিতৃহৃদয় পুরোপুরি জুড়ে বসেছেন, ঠিক সেই সময় আল্লাহ ইবরাহীমের মহববতের কুরবানী কামনা করলেন। বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র নয়নের পুত্তলী ইসমাঈলের মহববত ইবরাহীমকে কাবু করে ফেলল কি-না, আল্লাহ যেন সেটাই যাচাই করতে চাইলেন। ইতিপূর্বে অগ্নিপরীক্ষা দেবার সময় ইবরাহীমের কোন পিছুটান ছিল না। কিন্তু এবার রয়েছে প্রচন্ড রক্তের টান।
দ্বিতীয়তঃ অগ্নি পরীক্ষায় বাদশাহ তাকে বাধ্য করেছিল। কিন্তু এবারের পরীক্ষা স্বেচ্ছায় ও স্বহস্তে সম্পন্ন করতে হবে। তাই এ পরীক্ষাটি ছিল পূর্বের কঠিন অগ্নি পরীক্ষার চেয়ে নিঃসন্দেহে কঠিনতর। সূরা ছাফফাত ১০২ আয়াত হ’তে ১০৯ আয়াত পর্যন্ত এ বিষয়ে বর্ণিত ঘটনাটি নিম্নরূপ:
ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺑَﻠَﻎَ ﻣَﻌَﻪُ ﺍﻟﺴَّﻌْﻲَ ﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﺑُﻨَﻲَّ ﺇِﻧِّﻲ ﺃَﺭَﻯ ﻓِﻲ ﺍﻟْﻤَﻨَﺎﻡِ ﺃَﻧِّﻲ ﺃَﺫْﺑَﺤُﻚَ ﻓَﺎﻧﻈُﺮْ ﻣَﺎﺫَﺍ ﺗَﺮَﻯ ﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﺃَﺑَﺖِ ﺍﻓْﻌَﻞْ ﻣَﺎ ﺗُﺆْﻣَﺮُ ﺳَﺘَﺠِﺪُﻧِﻲ ﺇِﻥ ﺷَﺂﺀَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﺑِﺮِﻳﻦَ
‘যখন (ইসমাঈল) পিতার সাথে চলাফেরা করার মত বয়সে উপনীত হ’ল, তখন (ইবরাহীম) তাকে বললেন, হে আমার বেটা! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবহ করছি। এখন বল তোমার অভিমত কি? সে বলল, হে পিতা! আপনাকে যা নির্দেশ করা হয়েছে, আপনি তা কার্যকর করুন। আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাবেন’ (ছাফফাত ৩৭/১০২)।
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, মক্কা থেকে বের করে ৮ কি: মি: দক্ষিণ-পূর্বে মিনা প্রান্তরে নিয়ে যাওয়ার পথে বর্তমানে যে তিন স্থানে হাজীগণ শয়তানকে পাথর মেরে থাকেন, ঐ তিন স্থানে ইবলীস তিনবার ইবরাহীম (আঃ)-কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল। আর তিনবারই ইবরাহীম (আঃ) শয়তানের প্রতি ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করেছিলেন।[22] সেই স্মৃতিকে জাগরুক রাখার জন্য এবং শয়তানের প্রতারণার বিরুদ্ধে মুমিনকে বাস্তবে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এ বিষয়টিকে হজ্জ অনুষ্ঠানের ওয়াজিবাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানেই অনতিদূরে পূর্ব দিকে ‘মসজিদে খায়েফ’ অবস্থিত।
অতঃপর পিতা-পুত্র আল্লাহ নির্দেশিত কুরবানগাহ ‘মিনায়’ উপস্থিত হ’লেন। সেখানে পৌঁছে পিতা পুত্রকে তাঁর স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলেন এবং পুত্রের অভিমত চাইলেন। পুত্র তার অভিমত ব্যক্ত করার সময় বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ছবরকারীদের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাবেন’। ইনশাআল্লাহ না বললে হয়ত তিনি ধৈর্য ধারণের তাওফীক পেতেন না। এরপর তিনি নিজেকে ‘ছবরকারী’ না বলে ‘ছবরকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ বলেছেন এবং এর মাধ্যমে নিজের পিতা সহ পূর্বেকার বড় বড় আত্মোৎসর্গকারীদের মধ্যে নিজেকে শামিল করে নিজেকে অহমিকা মুক্ত করেছেন। যদিও তাঁর ন্যায় তরুণের এরূপ স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গের ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেছিল বলে জানা যায় না। আল্লাহ বলেন,
ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺃَﺳْﻠَﻤَﺎ ﻭَ ﺗَﻠَّﻪُ ﻟِﻠْﺠَﺒِﻴﻦِ، ﻭَﻧَﺎﺩَﻳْﻨَﺎﻩُ ﺃَﻥ ﻳَّﺂ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢُ، ﻗَﺪْ ﺻَﺪَّﻗْﺖَ ﺍﻟﺮُّﺅْﻳَﺎ ﺇِﻧَّﺎ ﻛَﺬَﺍﻟِﻚَ ﻧَﺠْﺰِﻱ ﺍﻟْﻤُﺤْﺴِﻨِﻴْﻦَ، ﺇِﻥَّ ﻫَﺬَﺍ ﻟَﻬُﻮَ ﺍﻟْﺒَﻶﺀُ ﺍﻟْﻤُﺒِﻴْﻦُ، ﻭَﻓَﺪَﻳْﻨَﺎﻩُ ﺑِﺬِﺑْﺢٍ ﻋَﻈِﻴْﻢٍ، ﻭَﺗَﺮَﻛْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻓِﻲ ﺍﻟْﺂﺧِﺮِﻳْﻦَ، ﺳَﻼَﻡٌ ﻋَﻠَﻰ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ
‘অতঃপর (পিতা-পুত্র) উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শায়িত করল’। ‘তখন আমরা তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহীম’! ‘তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। আমরা এভাবেই সৎকর্মশীলগণের প্রতিদান দিয়ে থাকি’। ‘নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা’। ‘আর আমরা তার পরিবর্তে একটি মহান যবহ প্রদান করলাম’ ‘এবং আমরা এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’। ‘ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হৌক’ (ছাফফাত ৩৭/১০৩-১০৯)। বর্তমানে উক্ত মিনা প্রান্তরেই হাজীগণ কুরবানী করে থাকেন এবং বিশ্ব মুসলিম ঐ সুন্নাত অনুসরণে ১০ই যুলহিজ্জাহ বিশ্বব্যাপী শরী‘আত নির্ধারিত পশু কুরবানী করে থাকেন।

 

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী :

বাবেল জীবনে ৭টি ও কেন‘আন জীবনে ৫টি বড় বড় পরীক্ষা বর্ণনার পর এবারে আমরা ইবরাহীম (আঃ)-এর জীবনের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ও শিক্ষণীয় ঘটনাবলী বিবৃত করব।-

(১) ইসহাক জন্মের সুসংবাদ :

পুত্র কুরবানীর ঘটনার পরে ইবরাহীম (আঃ) কেন‘আনে ফিরে এলেন। এসময় বন্ধ্যা স্ত্রী সারাহ্-র গর্ভে ভবিষ্যৎ সন্তান ইসহাক জন্মের সুসংবাদ নিয়ে ফেরেশতাদের শুভাগমন ঘটে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, উক্ত ফেরেশতাগণ ছিলেন হযরত জিবরাঈল, মীকাঈল ও ইসরাফীল। তারা মানুষের রূপ ধারণ করে এসেছিলেন। এ বিষয়ে কুরআনী বক্তব্য নিম্নরূপ:
ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﺟَﺎﺀَﺕْ ﺭُﺳُﻠُﻨَﺎ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ ﺑِﺎﻟْﺒُـﺸْﺮَﻯ ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﺳَﻼَﻣﺎً ﻗَﺎﻝَ ﺳَﻼَﻡٌ ﻓَﻤَﺎ ﻟَﺒِﺚَ ﺃَﻥْ ﺟَﺎﺀ ﺑِﻌِﺠْﻞٍ ﺣَﻨِﻴْﺬٍ
‘আর আমাদের প্রেরিত সংবাদবাহকগণ (অর্থাৎ ফেরেশতাগণ) ইবরাহীমের নিকটে সুসংবাদ নিয়ে এল এবং বলল, সালাম। সেও বলল, সালাম। অতঃপর অল্পক্ষণের মধ্যেই সে একটা ভূণা করা বাছুর এনে (তাদের সম্মুখে) পেশ করল’
(হূদ ১১/৬৯)। ‘কিন্তু সে যখন দেখল যে, মেহমানদের হাত সেদিকে প্রসারিত হচ্ছে না, তখন সে সন্দেহে পড়ে গেল ও মনে মনে তাদের সম্পর্কে ভয় অনুভব করতে লাগল (কারণ এটা তখনকার যুগের খুনীদের নীতি ছিল যে, যাকে তারা খুন করতো, তার বাড়ীতে তারা খেত না)। তারা বলল, আপনি ভয় পাবেন না। আমরা লূত্বের কওমের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। তার স্ত্রী (সারা) নিকটেই দাঁড়িয়েছিল, সে হেসে ফেলল। আমরা তাকে ইসহাকের জন্মের সুখবর দিলাম এবং ইসহাকের পরে (তার পুত্র) ইয়াকূবেরও। সে বলল, হায় কপাল! আমি সন্তান প্রসব করব? অথচ আমি বার্ধক্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। আর আমার স্বামীও বৃদ্ধ। এতো ভারী আশ্চর্য কথা! তারা বলল, আপনি আল্লাহর নির্দেশের বিষয়ে আশ্চর্য বোধ করছেন? হে গৃহবাসীগণ! আপনাদের উপরে আল্লাহর রহমত ও প্রভূত বরকত রয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রশংসিত ও মহিমময়’ (হূদ ১১/৭০-৭৩)। একই ঘটনা আলোচিত হয়েছে সূরা হিজর ৫২-৫৬ ও সূরা যারিয়াত ২৪-৩০ আয়াত সমূহে।
উল্লেখ্য যে, অধিক মেহমানদারীর জন্য ইবরাহীমকে ‘আবুয যায়ফান’ (ﺍﺑﻮ ﺍﻟﻀﻴﻔﺎﻥ) বা মেহমানদের পিতা বলা হ’ত। এই সময় বিবি সারাহর বয়স ছিল অন্যূন ৯০ ও ইবরাহীমের ছিল ১০০ বছর। সারাহ নিজেকে বন্ধ্যা মনে করতেন এবং সেকারণেই সেবিকা হাজেরাকে স্বামীর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন ও তাঁর সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন সন্তান লাভের জন্য। অথচ সেই ঘরে ইসমাঈল জন্মের পরেও তাকে তার মা সহ মক্কায় নির্বাসনে রেখে আসতে হয় আল্লাহর হুকুমে। ফলে সংসার ছিল আগের মতই নিরানন্দময়। কিন্তু আল্লাহর কি অপূর্ব লীলা! তিনি শুষ্ক নদীতে বান ডাকাতে পারেন। তাই নিরাশ সংসারে তিনি আশার বন্যা ছুটিয়ে দিলেন। যথাসময়ে ইসহাকের জন্ম হ’ল। যিনি পরে নবী হ’লেন এবং তাঁরই পুত্র ইয়াকূবের বংশধারায় ঈসা পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হাযার হাযার নবী প্রেরিত হ’লেন। ফলে হতাশ ও বন্ধ্যা নারী সারাহ এখন কেবল ইসহাকের মা হ’লেন না। বরং তিনি হ’লেন হাযার হাযার নবীর মা বা ‘উম্মুল আম্বিয়া’ ( ﺍﻡ ﺍﻷﻧﺒﻴﺎﺀ )। ওদিকে মক্কায় ইসমাঈলের বয়স তখন ১৩/১৪ বৎসর। যাকে বলা হয়ে থাকে ‘আবুল আরব’ (ﺍﺑﻮ ﺍﻟﻌﺮﺏ) বা আরব জাতির পিতা।

(২) মৃতকে জীবিত করার দৃশ্য প্রত্যক্ষকরণ :

বন্ধ্যা স্ত্রী সারাহর বৃদ্ধ বয়সে সন্তান লাভের মাধ্যমে আল্লাহ যেভাবে তাদের ঈমান বর্ধিত ও মযবূত করেছিলেন। সম্ভবত: তাতে উৎসাহিত হয়ে ইবরাহীম (আঃ) একদিন আল্লাহর কাছে দাবী করে বসলেন, আপনি কিভাবে মৃতকে জীবিত করেন, তা আমাকে একটু দেখান, যাতে হৃদয়ে প্রশান্তি আসে। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ:
ﻭَﺇِﺫْ ﻗَﺎﻝَ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢُ ﺭَﺏِّ ﺃَﺭِﻧِﻲْ ﻛَﻴْﻒَ ﺗُﺤْﻴِـﻲ ﺍﻟْﻤَﻮْﺗَﻰ ﻗَﺎﻝَ ﺃَﻭَﻟَﻢْ ﺗُﺆْﻣِﻦْ ﻗَﺎﻝَ ﺑَﻠَﻰ ﻭَﻟَـﻜِﻦ ﻟِّﻴَﻄْﻤَﺌِﻦَّ ﻗَﻠْﺒِﻲْ ﻗَﺎﻝَ ﻓَﺨُﺬْ ﺃَﺭْﺑَﻌَﺔً ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻄَّﻴْﺮِ ﻓَﺼُﺮْﻫُﻦَّ ﺇِﻟَﻴْﻚَ ﺛُﻢَّ ﺍﺟْﻌَﻞْ ﻋَﻠَﻰ ﻛُﻞِّ ﺟَﺒَﻞٍ ﻣِّﻨْﻬُﻦَّ ﺟُﺰْﺀﺍً ﺛُﻢَّ ﺍﺩْﻋُﻬُﻦَّ ﻳَﺄْﺗِﻴْﻨَﻚَ ﺳَﻌْﻴﺎً ﻭَﺍﻋْﻠَﻢْ ﺃَﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻋَﺰِﻳْﺰٌ ﺣَﻜِﻴْﻢٌ
‘আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে দেখাও কিভাবে তুমি (ক্বিয়ামতের দিন) মৃতকে জীবিত করবে। আল্লাহ বললেন, তুমি কি বিশ্বাস কর না? (ইবরাহীম) বলল, অবশ্যই করি। কিন্তু দেখতে চাই কেবল এজন্য, যাতে হৃদয়ে প্রশান্তি লাভ করতে পারি। বললেন, তাহ’লে চারটি পাখি ধরে নাও এবং সেগুলিকে নিজের পোষ মানিয়ে নাও। অতঃপর সেগুলোকে (যবেহ করে) সেগুলির দেহের একেকটি অংশ বিভিন্ন পাহাড়ের উপরে রেখে আস। তারপর সেগুলিকে ডাক দাও। (দেখবে) তোমার দিকে দৌড়ে চলে আসবে (উড়তে উড়তে নয়। কেননা তাতে অন্যান্য পাখির সাথে মিশে গিয়ে তোমার দৃষ্টি বিভ্রম ঘটতে পারে যে, সেই চারটি পাখি কোন্ কোন্টি)। জেনে রেখ যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রান্ত ও জ্ঞানময়’
(বাক্বারাহ ২/২৬০)।
উপরোক্ত ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ মুশরিক ও নাস্তিক সমাজকে দেখিয়ে দিলেন যে, কিভাবে মাটিতে মিশে যাওয়া মৃত মানুষকে তিনি ক্বিয়ামতের দিন পুনর্জীবন দান করবেন।

(৩) বায়তুল্লাহ নির্মাণ:

বায়তুল্লাহ প্রথমে ফেরেশতাগণ নির্মাণ করেন। অতঃপর হযরত আদম (আঃ) পুনর্নিমাণ করেন জিব্রীলের ইঙ্গিত মতে। তারপর নূহের তূফানের সময় বায়তুল্লাহর প্রাচীর বিনষ্ট হ’লেও ভিত্তি আগের মতই থেকে যায়। পরবর্তীতে আল্লাহর হুকুমে একই ভিত্তিভূমিতে ইবরাহীম তা পুনর্নির্মাণ করেন। এই নির্মাণকালে ইবরাহীম (আঃ) কেন‘আন থেকে মক্কায় এসে বসবাস করেন। ঐ সময় মক্কায় বসতি গড়ে উঠেছিল এবং ইসমাঈল তখন বড় হয়েছেন এবং বাপ-বেটা মিলেই কা‘বা গৃহ নির্মাণ করেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তখন থেকে অদ্যাবধি কা‘বা গৃহে অবিরত ধারায় হজ্জ ও ত্বাওয়াফ চালু আছে এবং হরম ও তার অধিবাসীগণ পূর্ণ শান্তি, নিরাপত্তা ও মর্যাদা সহকারে সেখানে বসবাস করে আসছেন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা সমূহ নিম্নরূপ:
আল্লাহ বলেন,
ﻭَﺇِﺫْ ﺑَﻮَّﺃْﻧَﺎ ﻟِﺈِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ ﻣَﻜَﺎﻥَ ﺍﻟْﺒَﻴْﺖِ ﺃَﻥ ﻻَّ ﺗُﺸْﺮِﻙْ ﺑِﻲْ ﺷَﻴْﺌﺎً ﻭَﻃَﻬِّﺮْ ﺑَﻴْﺘِﻲَ ﻟِﻠﻄَّﺎﺋِﻔِﻴْﻦَ ﻭَﺍﻟْﻘَﺎﺋِﻤِﻴْﻦَ ﻭَﺍﻟﺮُّﻛَّﻊِ ﺍﻟﺴُّﺠُﻮْﺩِ
‘আর যখন আমরা ইবরাহীমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়ে বলেছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখো তাওয়াফকারীদের জন্য, ছালাতে দন্ডায়মানদের জন্য ও রুকূ-সিজদাকারীদের জন্য’ (হজ্জ ২২/২৬)। আল্লাহ বলেন,
ﻭَﺃَﺫِّﻥ ﻓِﻲ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﺑِﺎﻟْﺤَﺞِّ ﻳَﺄْﺗُﻮﻙَ ﺭِﺟَﺎﻻً ﻭَﻋَﻠَﻰ ﻛُﻞِّ ﺿَﺎﻣِﺮٍ ﻳَﺄْﺗِﻴﻦَ ﻣِﻦْ ﻛُﻞِّ ﻓَﺞٍّ ﻋَﻤِﻴْﻖٍ – ﻟِﻴَﺸْﻬَﺪُﻭﺍ ﻣَﻨَﺎﻓِﻊَ ﻟَﻬُﻢْ ﻭَﻳَﺬْﻛُﺮُﻭﺍ ﺍﺳْﻢَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻓِﻲ ﺃَﻳَّﺎﻡٍ ﻣَّﻌْﻠُﻮﻣَﺎﺕٍ ﻋَﻠَﻰ ﻣَﺎ ﺭَﺯَﻗَﻬُﻢ ﻣِّﻦ ﺑَﻬِﻴﻤَﺔِ ﺍﻟْﺄَﻧْﻌَﺎﻡِ ﻓَﻜُﻠُﻮﺍ ﻣِﻨْﻬَﺎ ﻭَﺃَﻃْﻌِﻤُﻮﺍ ﺍﻟْﺒَﺎﺋِﺲَ ﺍﻟْﻔَﻘِﻴﺮَ
‘আর তুমি মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা জারি করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং (দীর্ঘ সফরের কারণে) সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত হ’তে। যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং (কুরবানীর) নির্দিষ্ট দিনগুলিতে (১০, ১১, ১২ই যিলহাজ্জ) তাঁর দেওয়া চতুষ্পদ পশু সমূহ যবেহ করার সময় তাদের উপরে আল্লাহর নাম স্মরণ করে। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং আহার করাও অভাবী ও দুস্থদেরকে’ (হজ্জ ২২/২৭-২৮)।
উপরোক্ত আয়াতগুলিতে কয়েকটি বিষয় জানা যায়। যেমন- (১) বায়তুল্লাহ ও তার সন্নিকটে কোনরূপ শিরক করা চলবে না (২) এটি স্রেফ তাওয়াফকারী ও আল্লাহর ইবাদতকারীদের জন্য নির্দিষ্ট হবে (৩) এখানে কেবল মুমিন সম্প্রদায়কে হজ্জের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
হযরত ইবরাহীম (আঃ) মাক্বামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে এবং কোন কোন বর্ণনা মতে আবু কুবায়েস পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে দুই কানে আঙ্গুল ভরে সর্বশক্তি দিয়ে উচ্চ কণ্ঠে চারদিকে ফিরে বারবার হজ্জের উক্ত ঘোষণা জারি করেন।
ইমাম বাগাভী হযরত ইবনু আববাসের সূত্রে বলেন যে, ইবরাহীমের উক্ত ঘোষণা আল্লাহ পাক সাথে সাথে বিশ্বের সকল প্রান্তে মানুষের কানে কানে পৌঁছে দেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ইবরাহীমী আহবানের জওয়াবই হচ্ছে হাজীদের ‘লাববায়েক আল্লা-হুম্মা লাববায়েক’ (হাযির, হে প্রভু আমি হাযির) বলার আসল ভিত্তি। সেদিন থেকে এযাবত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হ’তে মানুষ চলেছে কা‘বার পথে কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ উটে, কেউ গাড়ীতে, কেউ বিমানে, কেউ জাহাযে ও কেউ অন্য পরিবহনে করে। আবরাহার মত অনেকে চেষ্টা করেও এ স্রোত কখনো ঠেকাতে পারেনি। পারবেও না কোনদিন ইনশাআল্লাহ। দিন-রাত, শীত-গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে সর্বদা চলছে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ও ছাফা-মারওয়ার সাঈ। আর হজ্জের পরে চলছে কুরবানী। এভাবে ইবরাহীম ও ইসমাঈলের স্মৃতি চির অম্লান হয়ে আছে মানব ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে। এক কালের চাষাবাদহীন বিজন পাহাড়ী উপত্যকা ইবরাহীমের দো‘আর বরকতে হয়ে উঠলো বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সম্মিলন স্থল হিসাবে। যেমন আল্লাহ বলেন,
ﻭَﺇِﺫْ ﺟَﻌَﻠْﻨَﺎ ﺍﻟْﺒَﻴْﺖَ ﻣَﺜَﺎﺑَﺔً ﻟِّﻠﻨَّﺎﺱِ ﻭَﺃَﻣْﻨﺎً ﻭَﺍﺗَّﺨِﺬُﻭْﺍ ﻣِﻦ ﻣَّﻘَﺎﻡِ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ ﻣُﺼَﻠًّﻰ ﻭَﻋَﻬِﺪْﻧَﺎ ﺇِﻟَﻰ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ ﻭَﺇِﺳْﻤَﺎﻋِﻴْﻞَ ﺃَﻥْ ﻃَﻬِّﺮَﺍ ﺑَﻴْﺘِﻲَ ﻟِﻠﻄَّﺎﺋِﻔِﻴْﻦَ ﻭَﺍﻟْﻌَﺎﻛِﻔِﻴْﻦَ ﻭَﺍﻟﺮُّﻛَّﻊِ ﺍﻟﺴُّﺠُﻮْﺩِ
‘যখন আমরা কা‘বা গৃহকে লোকদের জন্য সম্মিলনস্থল ও শান্তিধামে পরিণত করলাম (আর বললাম,) তোমরা ইবরাহীমের দাঁড়ানোর স্থানটিকে ছালাতের স্থান হিসাবে গ্রহণ কর। অতঃপর আমরা ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ই‘তেকাফকারী ও রুকূ-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর’ (বাক্বারাহ ২/১২৫)।
ﻭَﺇِﺫْ ﻗَﺎﻝَ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢُ ﺭَﺏِّ ﺍﺟْﻌَﻞْ ﻫَـَﺬَﺍ ﺑَﻠَﺪﺍً ﺁﻣِﻨﺎً ﻭَﺍﺭْﺯُﻕْ ﺃَﻫْﻠَﻪُ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺜَّﻤَﺮَﺍﺕِ ﻣَﻦْ ﺁﻣَﻦَ ﻣِﻨْﻬُﻢ ﺑِﺎﻟﻠﻪِ ﻭَﺍﻟْﻴَﻮْﻡِ ﺍﻵﺧِﺮِ ﻗَﺎﻝَ ﻭَﻣَﻦ ﻛَﻔَﺮَ ﻓَﺄُﻣَﺘِّﻌُﻪُ ﻗَﻠِﻴْﻼً ﺛُﻢَّ ﺃَﺿْﻄَﺮُّﻩُ ﺇِﻟَﻰ ﻋَﺬَﺍﺏِ ﺍﻟﻨَّﺎﺭِ ﻭَﺑِﺌْﺲَ ﺍﻟْﻤَﺼِﻴْﺮُ
‘(স্মরণ কর) যখন ইবরাহীম বলল, পরওয়ারদেগার! এ স্থানকে তুমি শান্তির নগরীতে পরিণত কর এবং এর অধিবাসীদেরকে তুমি ফল-ফলাদি দ্বারা রূযী দান কর- যারা তাদের মধ্যে আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে। (আল্লাহ) বললেন, যারা অবিশ্বাস করে, আমি তাদেরকেও কিছু ভোগের সুযোগ দেব। অতঃপর তাদেরকে আমি যবরদস্তি জাহান্নামের আযাবে ঠেলে দেব। কতই না মন্দ ঠিকানা সেটা’ (বাক্বারাহ ২/১২৬)।
ইবরাহীমের উপরোক্ত প্রার্থনা অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে। যেমন আল্লাহ বলেন,
ﻭَﺇِﺫْ ﻗَﺎﻝَ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢُ ﺭَﺏِّ ﺍﺟْﻌَﻞْ ﻫَـﺬَﺍ ﺍﻟْﺒَﻠَﺪَ ﺁﻣِﻨﺎً ﻭَﺍﺟْﻨُﺒْﻨِﻲْ ﻭَﺑَﻨِﻲَّ ﺃَﻥْ ﻧَّﻌْﺒُﺪَ ﺍﻷَﺻْﻨَﺎﻡَ – ﺭَﺏِّ ﺇِﻧَّﻬُﻦَّ ﺃَﺿْﻠَﻠْﻦَ ﻛَﺜِﻴﺮﺍً ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻓَﻤَﻦْ ﺗَﺒِﻌَﻨِﻲ ﻓَﺈِﻧَّﻪُ ﻣِﻨِّﻲْ ﻭَﻣَﻦْ ﻋَﺼَﺎﻧِﻲ ﻓَﺈِﻧَّﻚَ ﻏَﻔُﻮﺭٌ ﺭَّﺣِﻴْﻢٌ
‘যখন ইবরাহীম বলল, হে আমার পালনকর্তা! এ শহরকে তুমি শান্তিময় করে দাও এবং আমাকে ও আমার সন্তান-সন্ততিকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখ’
(ইবরাহীম ৩৫)। ‘হে আমার পালনকর্তা! এরা (মূর্তিগুলো) অনেক মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে। অতএব যে আমার অনুসরণ করে, সে আমার দলভুক্ত। আর যে আমার অবাধ্যতা করে, নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ইবরাহীম ১৪/৩৬)।
অতঃপর কা‘বা গৃহ নির্মাণ শেষে পিতা-পুত্র মিলে যে প্রার্থনা করেন, তা যেমন ছিল অন্তরভেদী, তেমনি ছিল সুদূরপ্রসারী ফলদায়ক। যেমন আল্লাহ বলেন,
ﻭَﺇِﺫْ ﻳَﺮْﻓَﻊُ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢُ ﺍﻟْﻘَﻮَﺍﻋِﺪَ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﺒَﻴْﺖِ ﻭَﺇِﺳْﻤَﺎﻋِﻴْﻞُ ﺭَﺑَّﻨَﺎ ﺗَﻘَﺒَّﻞْ ﻣِﻨَّﺎ ﺇِﻧَّﻚَ ﺃَﻧْﺖَ ﺍﻟﺴَّﻤِﻴْﻊُ ﺍﻟْﻌَﻠِﻴْﻢُ – ﺭَﺑَّﻨَﺎ ﻭَﺍﺟْﻌَﻠْﻨَﺎ ﻣُﺴْﻠِﻤَﻴْﻦِ ﻟَﻚَ ﻭَﻣِﻦْ ﺫُﺭِّﻳَّﺘِﻨَﺎ ﺃُﻣَّﺔً ﻣُّﺴْﻠِﻤَﺔً ﻟَّﻚَ ﻭَﺃَﺭِﻧَﺎ ﻣَﻨَﺎﺳِﻜَﻨَﺎ ﻭَﺗُﺐْ ﻋَﻠَﻴْﻨَﺎ ﺇِﻧَّﻚَ ﺃَﻧْﺖَ ﺍﻟﺘَّﻮَّﺍﺏُ ﺍﻟﺮَّﺣِﻴْﻢُ – ﺭَﺑَّﻨَﺎ ﻭَﺍﺑْﻌَﺚْ ﻓِﻴﻬِﻢْ ﺭَﺳُﻮﻻً ﻣِّﻨْﻬُﻢْ ﻳَﺘْﻠُﻮ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﺁﻳَﺎﺗِﻚَ ﻭَﻳُﻌَﻠِّﻤُﻬُﻢُ ﺍﻟْﻜِﺘَﺎﺏَ ﻭَﺍﻟْﺤِﻜْﻤَﺔَ ﻭَﻳُﺰَﻛِّﻴْﻬِﻢْ ﺇِﻧَّﻚَ ﺃَﻧْﺖَ ﺍﻟﻌَﺰِﻳﺰُ ﺍﻟﺤَﻜِﻴﻢُ
‘স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কা‘বা গৃহের ভিত নির্মাণ করল এবং দো‘আ করল- ‘প্রভু হে! তুমি আমাদের (এই খিদমত) কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’। ‘হে প্রভু! তুমি আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহে পরিণত কর এবং আমাদের বংশধরগণের মধ্য থেকেও তোমার প্রতি একটা অনুগত দল সৃষ্টি কর। তুমি আমাদেরকে হজ্জের নীতি-নিয়ম শিখিয়ে দাও এবং আমাদের তওবা কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি তওবা কবুলকারী ও দয়াবান’। ‘হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি এদের মধ্য থেকেই এদের নিকটে একজন রাসূল প্রেরণ কর, যিনি তাদের নিকটে এসে তোমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই তুমি পরাক্রমশালী ও দূরদৃষ্টিময়’ (বাক্বারাহ ২/১২৭-১২৯)।
ইবরাহীম ও ইসমাঈলের উপরোক্ত দো‘আ আল্লাহ কবুল করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে তাদের বংশে চিরকাল একদল মুত্তাকী পরহেযগার মানুষের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। তাঁদের পরের সকল নবী তাঁদের বংশধর ছিলেন। কা‘বার খাদেম হিসাবেও চিরকাল তাদের বংশের একদল দ্বীনদার লোক সর্বদা নিয়োজিত ছিল। কা‘বার খেদমতের কারণেই তাদের সম্মান ও মর্যাদা সারা আরবে এমনকি আরবের বাইরেও বিস্তার লাভ করেছিল। আজও সঊদী বাদশাহদের লক্বব হ’ল ‘খাদেমুল হারামায়েন আশ-শারীফায়েন’ (দুই পবিত্র হরমের সেবক)। কেননা বাদশাহীতে নয়, হারামায়েন-এর সেবক হওয়াতেই গৌরব বেশী।
ইবরাহীমের দো‘আর ফসল হিসাবেই মক্কায় আগমন করেন বিশ্বনবী ও শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। তিনি বলতেন, ﺃَﻧَﺎ ﺩَﻋْﻮَﺓُ ﺃَﺑِﻲْ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ ﻭَﺑُﺸْﺮَﻯ ﻋِﻴْﺴَﻰ – ‘আমি আমার পিতা ইবরাহীমের দো‘আর ফসল ও ঈসার সুসংবাদ’।[23]
এই মহানগরীটি সেই ইবরাহীমী যুগ থেকেই নিরাপদ ও কল্যাণময় নগরী হিসাবে অদ্যাবধি তার মর্যাদা বজায় রেখেছে। জাহেলী আরবরাও সর্বদা একে সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখত। এমনকি কোন হত্যাকারী এমনকি কোন পিতৃহন্তাও এখানে এসে আশ্রয় নিলে তারা তার প্রতিশোধ নিত না। হরমের সাথে সাথে এখানকার অধিবাসীরাও সর্বত্র সমাদৃত হ’তেন এবং আজও হয়ে থাকেন।

পরীক্ষা সমূহের মূল্যায়ন :

ইবরাহীমের পরীক্ষা সমূহ তাঁর যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ছিল না বা তাঁর কোন অপরাধের সাজা হিসাবে ছিল না। বরং এর উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে লালন করে পূর্ণত্বের মহান স্তরে পৌছে দেওয়া এবং তাঁকে আগামী দিনে বিশ্বনেতার মর্যাদায় সমাসীন করা। সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে এটা দেখিয়ে দেওয়া যে, আল্লাহর নিকটে প্রিয় ও সম্মানিত বান্দাগণকে দুনিয়াতে বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ’তে হয়। আল্লাহর সুন্দর গুণাবলীর মধ্যে ﺭَﺑُّﻪُ (‘তার পালনকর্তা’) গুণটিকে খাছ করে বলার মধ্যে স্বীয় বন্ধুর প্রতি স্নেহ ও তাকে বিশেষ অনুগ্রহে লালন করার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। এক্ষণে তাঁর পরীক্ষার সংখ্যা কত ছিল সে বিষয়ে কুরআন নির্দিষ্টভাবে কিছু উল্লেখ করেনি। কেবল বলেছে, ﺑِﻜَﻠِﻤَﺎﺕٍ ‘অনেকগুলি বাণী দ্বারা’ (বাক্বারাহ ২/১২৪)। অর্থাৎ শরী‘আতের বহুবিধ আদেশ ও নিষেধ সমূহ দ্বারা। ‘কালেমাত’ শব্দটি বিবি মারিয়ামের জন্যেও ব্যবহৃত হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, ﻭَﺻَﺪَّﻗَﺖْ ﺑِﻜَﻠِﻤَﺎﺕِ ﺭَﺑِّﻬَﺎ ‘মারিয়াম তার পালনকর্তার বাণী সমূহকে সত্যে পরিণত করেছিল’ (তাহরীম ৬৬/১২)।
ইবরাহীমের জীবনে পরীক্ষার সংখ্যা কত ছিল এরূপ এক প্রশ্নের জবাবে ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ইসলামের ৩০টি অংশ রয়েছে। যার ১০টি সূরা তওবায়
(১১২ আয়াতে), ১০টি সূরা মুমিনূনে (১-৯ আয়াতে) ও সূরা মা‘আরিজে (২২-৩৪ আয়াতে) এবং বাকী ১০টি সূরা আহযাবে (৩৫ আয়াতে) বর্ণিত হয়েছে। যার সব ক’টি ইবরাহীম (আঃ) পূর্ণ করেন। অতঃপর  আল্লাহ তাকে সনদ দিয়ে বলেন, ﻭَﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ ﺍﻟَّﺬِﻯْ ﻭَﻓَّﻰ ‘এবং ইবরাহীমের ছহীফায়, যিনি (আনুগত্যের অঙ্গীকার) পূর্ণ করেছিলেন’ (নাজম ৫৩/৩৭)।[24] তবে ইবনু জারীর ও ইবনু কাছীর উভয়ে বলেন, ইবরাহীমের জীবনে যত সংখ্যক পরীক্ষাই আসুক না কেন আল্লাহ বর্ণিত ‘কালেমাত’ বহু বচনের শব্দটি সবকিছুকে শামিল করে’ (ইবনু কাছীর)।
বস্ত্ততঃ পরীক্ষা সমূহের সংখ্যা বর্ণনা করা কিংবা ইবরাহীমের সুক্ষ্মদর্শিতা ও জ্ঞানের গভীরতা যাচাই করা এখানে মুখ্য বিষয় নয়, বরং আল্লাহর প্রতি তাঁর আনুগত্যশীলতা ও নিখাদ আত্মসমর্পণ এবং কার্যক্ষেত্রে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা যাচাই করাই ছিল মুখ্য বিষয়।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ :

(১) ইবরাহীমকে আল্লাহ স্বপ্নাদেশ করেছিলেন, সরাসরি আদেশ করেননি। এর মধ্যে পরীক্ষা ছিল এই যে, স্বপ্নের বিভিন্ন ব্যাখ্যা হ’তে পারত। যেমন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা মহাপাপ। অধিকন্তু পিতা হয়ে নির্দোষ পুত্রকে নিজ হাতে হত্যা করা আরও বড় মহাপাপ। নিশ্চয়ই এমন অন্যায় কাজের নির্দেশ আল্লাহ দিতে পারেন না। অতএব এটা মনের কল্পনা-নির্ভর স্বপ্ন ( ﺃﺿﻐﺎﺙ ﺃﺣﻼﻡ ) হ’তে পারে। কিন্তু ইবরাহীম ঐসব ব্যাখ্যায় যাননি। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, এটা ‘অহি’। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি পরপর তিনদিন একই স্বপ্ন দেখেন। প্রশ্ন হ’তে পারে, আল্লাহ জিব্রীল মারফত সরাসরি নির্দেশ না পাঠিয়ে স্বপ্নের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠালেন কেন? এর জবাব এই যে, তাহ’লে তো পরীক্ষা হ’ত না, কেবল নির্দেশ পালন হ’ত। ইবরাহীমকে তার স্বপ্নের কাল্পনিক ব্যাখ্যার ফাঁদে ফেলার জন্যই তো শয়তান মাঝপথে বন্ধু সেজে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। এর দ্বারা আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর নির্দেশ পালনের সময় অহেতুক প্রশ্ন সমূহ উত্থাপন ও অধিক যুক্তিবাদের আশ্রয় নেওয়া যাবে না। বরং সর্বদা তার প্রকাশ্য অর্থের উপরে সহজ-সরলভাবে আমল করে যেতে হবে।
(২) আল্লাহর মহববত ও দুনিয়াবী কোন মহববত একত্রিত হ’লে সর্বদা আল্লাহর মহববতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং দুনিয়াবী মহববতকে কুরবানী দিতে হবে। ইবরাহীম এখানে সন্তানের গলায় ছুরি চালাননি। বরং সন্তানের মহববতের গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন। আর এটাই ছিল পরীক্ষা। যদি কেউ আল্লাহর মহববতের উপরে দুনিয়াবী মহববতকে অগ্রাধিকার দেয়, তখন সেটা হয়ে যায় ﺍﻹﺷﺮﺍﻙ ﻓﻲ ﺍﻟﻤﺤﺒﺔ বা ভালোবাসায় শিরক। ইবরাহীম ও ইসমাঈল দু’জনেই উক্ত শিরক হ’তে মুক্ত ছিলেন।
(৩) পিতা ও পুত্রের বিশ্বাসগত সমন্বয় ব্যতীত কুরবানীর এই গৌরবময় ইতিহাস রচিত হ’ত না। ইসমাঈল যদি পিতার অবাধ্য হ’তেন এবং দৌড়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যেতেন, তাহ’লে আল্লাহর হুকুম পালন করা ইবরাহীমের পক্ষে হয়তবা আদৌ সম্ভব হ’ত না। তাই এ ঘটনার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, সমাজের প্রবীণদের কল্যাণময় নির্দেশনা এবং নবীনদের আনুগত্য ও উদ্দীপনা একত্রিত ও সমন্বিত না হ’লে কখনোই কোন উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়।
(৪) এখানে মা হাজেরার অবদানও ছিল অসামান্য। যদি তিনি ঐ বিজন ভূমিতে কচি সন্তানকে তিলে তিলে মানুষ করে না তুলতেন এবং স্রেফ আল্লাহর উপরে ভরসা করে বুকে অসীম সাহস নিয়ে সেখানে বসবাস না করতেন, তাহ’লে পৃথিবী পিতা-পুত্রের এই মহান দৃশ্য অবলোকন করতে পারত না। এজন্যেই বাংলার বুলবুল কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেন,
মা হাজেরা হৌক মায়েরা সব
যবীহুল্লাহ হৌক ছেলেরা সব
সবকিছু যাক সত্য রৌক
বিধির বিধান সত্য হৌক।
বলা চলে যে, এই কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ইবরাহীম (আঃ) বিশ্ব নেতৃত্বের সম্মানে ভূষিত হন। যেমন আল্লাহ বলেন,
ﻭَﺇِﺫِ ﺍﺑْﺘَﻠَﻰ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢَ ﺭَﺑُّﻪُ ﺑِﻜَﻠِﻤَﺎﺕٍ ﻓَﺄَﺗَﻤَّﻬُﻦَّ ﻗَﺎﻝَ ﺇِﻧِّﻲْ ﺟَﺎﻋِﻠُﻚَ ﻟِﻠﻨَّﺎﺱِ ﺇِﻣَﺎﻣﺎً،
‘যখন ইবরাহীমকে তার পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তাতে উত্তীর্ণ হ’লেন, তখন আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করলাম’ (বাক্বারাহ ২/১২৪)।
উপরোক্ত আয়াতে পরীক্ষাগুলির সংখ্যা কত ছিল, তা বলা হয়নি। তবে ইবরাহীমের পুরো জীবনটাই যে ছিল পরীক্ষাময়, তা ইতিপূর্বেকার আলোচনায় প্রতিভাত হয়েছে।

৫) ইবরাহীমী জীবন থেকে প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হ’ল সর্বাবস্থায় আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ। যাকে বলা হয় ‘ইসলাম’। যেমন আল্লাহ বলেন,
ﺇِﺫْ ﻗَﺎﻝَ ﻟَﻪُ ﺭَﺑُّﻪُ ﺃَﺳْﻠِﻢْ ﻗَﺎﻝَ ﺃَﺳْﻠَﻤْﺖُ ﻟِﺮَﺏِّ ﺍﻟْﻌَﺎﻟَﻤِﻴْﻦَ، ﻭَﻭَﺻَّﻰ ﺑِﻬَﺎ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢُ ﺑَﻨِﻴْﻪِ ﻭَﻳَﻌْﻘُﻮْﺏُ
‘স্মরণ কর যখন তাকে তার পালনকর্তা বললেন, তুমি আত্মসমর্পণ কর। তখন সে বলল, আমি আত্মসমর্পণ করলাম বিশ্ব চরাচরের প্রতিপালকের নিকট’। ‘এবং একই বিষয়ে সন্তানদেরকে অছিয়ত করে যান ইবরাহীম ও ইয়াকূব’ (বাক্বারাহ ২/১৩১-৩২)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﺇِﺑْﺮَﺍﻫِﻴْﻢُ ﻳَﻬُﻮْﺩِﻳًّﺎ ﻭَﻻَ ﻧَﺼْﺮَﺍﻧِﻴًّﺎ ﻭَﻟَﻜِﻦْ ﻛَﺎﻥَ ﺣَﻨِﻴْﻔًﺎ ﻣُّﺴْﻠِﻤًﺎ

‘ইবরাহীম ইহুদী বা নাছারা ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন একনিষ্ঠরূপে ‘মুসলিম’ বা আত্মসমর্পিত’ (আলে ইমরান ৩/৬৭)।
অতএব ইহুদী, নাছারা ইত্যাদি দলীয় রং দিয়ে তাঁকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা বাতুলতা মাত্র। বরং তিনি ছিলেন নিখাদ আল্লাহ প্রেমিক। আর সেকারণ সকল আল্লাহভীরু মানুষের তিনি নেতা ছিলেন।
(৬) আল্লাহর কাছে বড় হ’তে গেলে তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকেই বড় বড় পরীক্ষায় ফেলা হয়। আর তাতে উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্যেই থাকে ইহকালীন ও পরকালীন সফলতা।
(৭) পরীক্ষা এলে সাহসিকতার সাথে মুকাবিলা করতে হয়। শয়তানী প্ররোচনায় পিছিয়ে গেলেই ব্যর্থ হ’তে হয়। যেমন পুত্র যবহের পূর্বে শয়তানী ধোঁকার বিরুদ্ধে ইবরাহীম (আঃ) কংকর নিক্ষেপ করেছিলেন ও পরে সফলকাম হয়েছিলেন।

উপসংহার :

ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রায় দু’শো বছরের পুরা জীবনটাই ছিল পরীক্ষার জীবন। সুখে-দুখে, আনন্দে-বিষাদে সর্বাবস্থায় তিনি ছিলেন আল্লাহর উপরে একান্ত নির্ভরশীল। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা তাঁকে তাঁর বিশ্বাস থেকে এক চুল টলাতে পারেনি। অবশেষে জন্মভূমি ত্যাগ করে হিজরত করে আসতেও তিনি পিছপা হননি। আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় বৃদ্ধ বয়সের নয়নের মণি একমাত্র শিশু পুত্রকে তার মা সহ মক্কার বিজনভূমিতে নির্বাসনে দিয়ে আসতেও তাঁর হৃদয় টলেনি। অবশেষে ঐ সন্তানকে যবেহ করার মত কঠিনতম উদ্যোগ নিতেও তাঁর হাত কেঁপে ওঠেনি। এভাবে জীবনভর অগণিত পরীক্ষার চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পূর্ণ-পরিণত ইবরাহীম পেলেন ‘বিশ্বনেতা’ হবার মত বিরল দুনিয়াবী পুরস্কারের মহান এলাহী ঘোষণা। হ’লেন ভবিষ্যৎ নবীগণের পিতা ‘আবুল আম্বিয়া’ এবং মিল্লাতে ইসলামিয়াহর নেতা হবার মত দুর্লভ সম্মান। আজও যদি পৃথিবীর দিকে দিকে ইবরাহীমী ঈমানের জ্যোতি বিকীরিত হয়, আবার মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সে ঈমান ফিরে আসে, তবে বর্তমান অশান্ত পৃথিবীর নমরূদী হুতাশন আবারও পুষ্পকাননে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ। ইকবাল তাই গেয়েছেন,
ﺍﮔﺮ ﻫﻮ ﭘﮩﺮ ﺍﺑﺮﺍﮬﯿﻢ ﮐﺎ ﺍﻳﻤﺎﮞ ﭘﻴﺪﺍ
ﺁﮒ ﮐﺮﺳﮑﺘﻲ ﻫﮯ ﭘﻬﺮ ﺍﻧﺪﺍﺯ ﮔﻠﺴﺘﺎﮞ ﭘﻴﺪﺍ
‘বিশ্বে যদি সৃষ্টি হয় ফের ইবরাহিমী ঈমান
হুতাশনে তবে সৃষ্টি হবে ফের পুষ্পের কানন’\

সূত্র :

[1]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৬৬ ‘মে‘রাজ’ অনুচ্ছেদ।
[2]. আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৪৫৩-৫৪; হাকেম ৪/৫৫৭-৫৮ পৃঃ প্রভৃতি।
[3]. তারীখুল আম্বিয়া পৃঃ ৬৮।
[4]. তারীখুল আম্বিয়া, পৃঃ ৭৪।
[5]. আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ ১/১৬৪ পৃ:।
[6]. যথাক্রমে সূরা বাক্বারাহ ২/১২৪-১৩৩=১০; ১৩৫, ১৩৬, ১৪০, ২৫৮, ২৬০; আলে ইমরান ৩/৩৩, ৩৪, ৬৫-৬৮=৪; ৮৪, ৯৫, ৯৬, ৯৭; নিসা ৪/৫৪, ১২৫, ১৬৩; আন‘আম ৬/৭৪-৮৩=১০; ১৬১; তওবাহ ৯/৭০, ১১৪; হূদ ১১/৬৯-৭৬=৮; ইউসুফ ১২/৬, ৩৮; ইবরাহীম ১৪/৩৫-৪১=৭; হিজর ১৫/৫১-৬০=১০; নাহ্ল ১৬/১২০-১২৩=৪; মারিয়াম ১৯/৪১-৫০=১০; ৫৮; আম্বিয়া ২১/৫১-৭৩=২৩; হজ্জ ২২/২৬, ৪৩, ৭৮; শো‘আরা ২৬/৬৯-৮৯=২১; আনকাবূত ২৯/১৬-২৭=১২; ৩১; আহযাব ৩৩/৭; ছাফফাত ৩৭/৮৩-১১৩=৩১; ছোয়াদ ৩৮/৪৫-৪৭=৩; শূরা ৪২/১৩; যুখরুফ ৪৩/২৬, ২৭; যারিয়াত ৫১/২৪-৩৪=১১; নাজম ৫৩/৩৭; হাদীদ ৫৭/২৬, ২৭; মুমতাহানা ৬০/৪-৬=৩; আ‘লা ৮৭/১৯,       সর্বমোট = ২০৪টি \
[7]. কুরতুবী, আন‘আম ৭৬ টীকা।
[8]. মুসলিম ‘জান্নাত’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৫৩৭১ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায় ৮ অনুচ্ছেদ।
[9].বুখারী, হা/৪৫৬৩ তাফসীর অধ্যায়, সূরা আলে-ইমরান ।
[10]. আলে ইমরান ৩/১৭৩; আর-রাহীক্ব পৃঃ ২৮৬।
[11]. কুরতুবী, আন‘আম ৭৫-এর টীকা।
[12]. ঢাকা, দৈনিক ইনকিলাব তাং ৭/৬/০৬ পৃঃ ১৩।
[13]. তারীখুল আম্বিয়া, পৃঃ ১২৪।
[14]. বুখারী হা/২২১৭ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়;  আহমাদ, সনদ ছহীহ।
[15]. ছহীহ বুখারী হা/৩৩৫৮ ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায়।
[16]. শামায়েলে তিরমিযী; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৯৮৭।
[17]. বুখারী (দেওবন্দ ১৯৮৫) ১/৫৫৬ পৃঃ হা/৩৯১১ ‘নবীর হিজরত’ অনুচ্ছেদ ; আর-রাহীক্ব পৃঃ ১৬৮।
[18]. ইহসান ইলাহী যহীর, আশ-শী‘আহ ওয়াস সুন্নাহ (লাহোর, পাকিস্তান : ইদারা তারজুমানুস সুন্নাহ, তাবি), পৃঃ ১৬৪-৬৫।
[19]. ত্বোয়াহা ২০/১২১।
[20]. ইবরাহীম ১৪/৩৭; বুখারী ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত দীর্ঘ হাদীছের সারসংক্ষেপ; ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায় হা/৩৩৬৪।
[21]. বুখারী, আবু হুরায়রা হ’তে হা/৩৩৫৬, ৬২৯৭; কুরতুবী হা/৬৫১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[22]. ইবনু আববাস হ’তে মুসনাদে আহমাদ হা/২৭০৭, ২৭৯৫, সনদ ছহীহ, শো‘আয়েব আরনাঊত্ব।
[23]. আহমাদ ও ছহীহ ইবনে হিববান, সিলসিলা ছাহীহাহ হা/১৫৪৫।
[24]. হাকেম ২/৫৫২ সনদ ছহীহ; তাফসীর ইবনে কাছীর, বাক্বারাহ ১১৪-এর টীকা দ্রষ্টব্য।